এক নীল সাগরের গল্প

মাত্র ৩৫০০ জনসংখ্যার ছোট্ট একটি জেলা শহর মালদ্বীপ। মালদ্বীপে জেলা শহরকে এ্যাটল বলে। এরকম ২৬টি এ্যাটলের একটি হল ভিলিনগিলি। এ এ্যাটলের অধীনে ৯টি ছোট্ট দ্বীপ (৯টি থানা হেলথ সেন্টার) বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত। সপ্তাহে ৩ দিন তারা এ্যাটলে আসেন চিকিৎসার জন্য।

মানুষবিহীন এ শহরটির সঙ্গে আমার ২২টি মাসের ভালবাসা জড়িত। নীলসাগরের মাঝে সাদা ধবধবে বকের মত একমাত্র এ্যাটল হাসপাতালটি দাঁড়িয়ে আছে। একজন শিশু বিশেষজ্ঞ হিসেবে এদেশের মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলাম দীর্ঘদিন। রাস্তা দিয়ে হাঁটলে বাচ্চারা কুদাকুদি ডাক্তার (এদেশে শিশুকে কুদাকুদি বলে)বলে ডাকাডাকি করতো। প্রথম প্রথম কুদাকুদি (আমাদের জন্য বেমানান শব্দ) শুনতে ভালো না লাগলেও পরে ঠিকই মজা পেতাম।

এদেশে চিকিৎসা ব্যয় সম্পূর্ণ ফ্রি। যাতায়াতের মাধ্যম হল স্পিডবোট /ফেরি/বিমান। জরুরি রোগীদের জন্য তাও ফ্রি। সেজন্য হাসপাতালে রোগীর আনাগোনা সব সময় বেশি থাকত। সামান্য সমস্যাতেই বাবা-মা বাচ্চা নিয়ে হাসপাতালে দৌড় দিত।এদের মধ্যে ৭০% আসতো ‘হোমা-কেছে-রোগাজি-হোডেলিয়ে-বারানতাদেবে-বোলাবারে’ (জ্বর -কাশি -কফ -বমি -পেটব্যথা -মাথাঘোরা)নিয়ে। এদের কাছ থেকে রোগের বর্ণনা শুনে চিকিৎসা দিলেই শেষ। ৯৯-১০০ তাপকে তারা হাই ফিভার হিসেবে জানে।১/২ বার বমিকে কমপক্ষে ১০ বার তো বলবেই। আর কতদিন থেকে কাশি জানতে চাইলে আর রেহাই নাই-মিনিমাম ২/৩ সপ্তাহ তো হবেই।

চাকরির প্রথম দিকে একদিন এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়ি। আমার অনুবাদক জানালেন স্যার ইমারজেন্সি রোগী এসেছে।এখানে সময় চুলে চুলে হিসাব হয়।মূহুর্তে হাজির হলাম।বাচ্চাটাকে দেখে তো স্বাভাবিক মনে হল।জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে। অনুবাদক জানালেন নাক দিয়ে ‍রক্ত পড়ছে।পরীক্ষা করে দেখলাম বাচ্চাটার ঠান্ডা লেগেছে -নাকের ভিতর একফোঁটা রক্তের জমাট আভা দেখা যাচ্ছে মাত্র। তাদের অতি সামান্য সমস্যাকে বাহ্যিকভাবে সিরিয়াসলি নিয়ে ওষুধ আর ইনজেকশন (৪ ঘন্টা অবজারভেশন রাখার ব্যবস্থা আছে) দিলে খুবই খুশি হয়।যাইহোক হাসপাতালে ইমারজেন্সি না থাকলে বিকাল ৪টার পরে ফ্রি।

চারদিকে সারিসারি নারকেল গাছ দেখে যে কারও মন ভরে যাবে। প্রতিদিন রাতে সাগরপাড়ে বিশেষ করে চাঁদনি রাতে ধূলাবালিহীন ঝিরিঝিরি বাতাসে হাঁটার তৃপ্তি অন্যরকম। কোনকোন সময় অনেকরাত পর্যন্ত সাগরপাড়ে বসে সীমাহীন আকাশের জলজলে তারাদের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম। উপরে তারার মেলা আর সাগরে রংবেরংয়ের মাছেদের আনাগোনা দেখতে দেখতে ঘড়িরকাটা মধ্যরাতে গিয়ে ঠেকতো।

এখানে চোর-ডাকাতের ভয় নাই। বন্দুক ছাড়া চৌকিদারের মত কিছু পুলিশ ঘুরঘুর করে মাত্র। তবে মটরসাইকেলের দেশে রাস্তায় চলতে একটু সাবধান হতে হত। দূর্ঘটনা এখানে খুবই কমন। কারনএরা ফাঁকা রাস্তায় বিমানের গতিতে মোটরসাইকেল চালায়।গারদিয়া (কোনরকম সিদধ টুনা মাছের স্যুপ)এদের প্রধান খাদ্য। সবই এরা সরকার থেকে ফ্রি পায়।ফ্রি জাতিকে অলস করে, মালদ্বীপ তার জলন্ত প্রমান। জমি উর্বর হলেও এরা চাষাবাদ করে না। প্রতিটা দ্বীপে অনেক বাংলাদেশির বাস।মালে থেকে ফ্রজেন খাদ্য খাবার দ্বীপে আসে।সবজি তেমন পাওয়া যায় না।

১২৫০ দ্বীপের দেশে সরকারি চাকরির সুবাদে অনেক সুন্দর সুন্দর দ্বীপে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। নীল পানির দেশে এতবেশি সেলফি উঠিয়েছি যে তা আমার সারাজীবনের চেয়েও বেশি। কিন্ত দিনে দিনে পরিবারের টান খুব বেশি অনুভব হতে লাগলো। বুঝতে পারলাম এবার যেতে হবে-যাওয়ার পালা। ২২টি মাস পর হাসপাতালের চিকিৎসক, সেবিকা,অনুবাদক সহ সবার আন্তরিকতা আর নীল পানীর ভালোবাসা ত্যাগ করে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিলাম নিজদেশের উদ্দেশ্যে।

এয়ারপোর্ট যেতে সাগর পাড়ি দিতে হয়।শেষবারের মত ভিলিনগিলিকে বিদায় দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে জেটিতে আসলাম। রঙিন পানিতে সাদা ধবধবে ছোট্ট একটা স্পিডবোট বাঁধা ছিল আমার জন্য। সিটে বসলাম।উঠার সঙ্গে সঙ্গে গভীর সাগরের বুকে উথাল-পাথাল ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্পিডবোট চলল এয়ারপোর্টের দিকে। সন্ধ্যায় প্লেনে ভিলিনগিলি থেকে মালে এয়ারপোর্টে এলাম।

ডোমেস্টিক ফ্লাইটের জন্য ছোট প্লেন। জার্নিও নাতিদীর্ঘ। এক ঘন্টার পথ। প্লেন যখন আকাশে তখন দিনের রং ফিকে হয়ে এসেছে। সিট বেল্ট বেঁধে নিয়েছি আগেই। ভাগ্য ভালো আমার সিটটা ছিল উইন্ডোর পাশে। ডোমেস্টিক প্লেন খুব বেশি ওপর দিয়ে ওড়ে না। প্লেনের জানালা দিয়ে আমি পাখির দৃষ্টিতে নিচে তাকালাম।আমি জানি নিচে ভারত মহাসাগরের অথৈ পানি। মালার মতো অসংখ্য দ্বীপ পানির বুকে জেগে আছে।

জানালা দিয়ে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম বিয়েবাড়িতে গাছকে যেমন আলোকশয্যায় সজ্জিত করা হয় তেমনি কিছুক্ষণ পরপর সোডিয়াম লাইটের আলোয় ভেসে যাওয়া দ্বীপগুলোকে একছড়া হীরার হারের মতো মনে হচ্ছে। আলো-আধারে নীলসাগর যেন কোনো রাজকন্যার গলায় জ্বলজ্বল করে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। অবাক দৃষ্টিতে সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব বিস্ময়লীলা দুচোখ ভরে দেখলাম।

মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিলাম। কতবার দেখেছি কিন্তু আজ যেন সাগরকে বেশি সুন্দর লাগছে, হয়ত বা শেষবার- বিদায়ের বেলা এমনটি মনে হচ্ছে। ঘোর ভাঙলো এনাউন্সমেণ্টে।

অ্যাটেনশন প্লিজ উই আর নিয়ার টু মালে….. প্লিজ ফিক্সড ইয়োর সিট বেল্ট।

এবার ডায়েরি বন্ধ করলাম।অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।

গুডবাই মালদ্বীপ’

এসএইচ-০৭/০১/১২ (ডা. মাহমুদুর রহমান, যুগান্তর)