মর্যাদার লড়াইয়ে বাংলাদেশি অভিবাসী

মানুষ জন্মগ্রহণ করে কতগুলো মৌলিক অধিকার নিয়ে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা পাবার অধিকার রয়েছে প্রত্যেকটি মানুষের। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে মানুষ নানা কারণে এক দেশ থেকে অন্য দেশে কিংবা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার অভিবাসী হয়েছে এবং হচ্ছে।

পুরো বিশ্বে নগর সভ্যতার সম্প্রসারণের প্রয়োজনে অভিবাসী সংশ্লিষ্টতা ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাও বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী নয়। এদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যেসব খাত বিশেষ ভূমিকা রাখে তার ভেতর ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান’ খাতটি অন্যতম। বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হওয়ায় একদিকে বেকারের সংখ্যা কমছে এবং অন্যদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।

অথচ মালয়েশিয়ায় অভিবাসন-প্রত্যাশী বাংলাদেশিদের প্রায় ৫১ শতাংশই প্রতারণা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অধিকার মর্যাদা ও ন্যায় বিচার পাওয়ার আশায় লড়াই করে চলেছেন অভিবাসীরা। কিন্তু কতটুকু ন্যায় বিচার, অধিকার ও মর্যাদা পেয়েছেন তারা। সরকারইবা তাদের অধিকার কতটুকু ফিরিয়ে দিতে পেরেছে।

প্রতি বছর গড়ে ২০ লাখের বেশি মানুষ নতুন করে দেশের শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। দেশের ভেতরে সরকারি ও বেসরকারী উদ্যোগে উল্লেখিত শ্রমশক্তির ৫ লাখের কম সংখ্যক মানুষের জন্য মানসম্মত কাজের সুযোগ থাকলেও বাকি বিপুল সংখ্যক আগ্রহী জনগোষ্ঠির উপযুক্ত চাকুরির ব্যবস্থা সরকারের পক্ষে করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

সরকার জনশক্তি রফতানী খাতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার কথা বললেও বাস্তবতা হলো প্রতিবছরই হাজার হাজার শ্রমিক প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে ফেরত আসেন। কতজন শ্রমিকের ক্ষেত্রে এমন হয়ে থাকে, তারও কোন পরিসংখ্যান নেই বাংলাদেশ সরকারও দূতাবাসের কাছে।

বিদেশে কাজের জন্য প্রচুর মানুষ বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় যান। এ বিপুল কর্মশক্তির একটি অংশ আবার বিদেশ থেকে বিভিন্ন কারনে বাংলাদেশে ফেরত আসে। তাছাড়া এদের মধ্যে অনেকে অপহরণের শিকার হয়ে মুক্তিপনের মাধ্যমে প্রাণে বেঁচে দেশে ফেরত আসেন। আবার অনেকে মারাও যান।

সম্প্রতি মালয়েশিয়ার মেন্তারি কোর্ট এলাকায় জামাল (২৮) নামের এক বাংলাদেশি শ্রমিককে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

এ ঘটনায় কোম্পানীর মালিক বাদী হয়ে মামলা করলেও এখনও তার সঠিক কোনো উদঘাটন করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। জামালের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। কে থামাবে জামালের পরিবারের কান্না?

লিজা বেগম (২৬) তিনি বছর খানেক আগে স্থানীয় দালালের হাত ধরে ট্যুরিষ্ট ভিসায় কাজের জন্য গিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। পাঁচ মাসের মাথায় নির্যাতনের শিকার হয়ে দীর্ঘদিন জেল খেটে ফিরে আসেন তিনি। মালয়েশিয়া থেকে এক কাপড়েই ফিরতে হয়েছে তাকে।

রিপন কুমার বিশ্বাস নামের আরেকজন, বছর খানেক আগে দুই লাখ টাকার বেশি খরচ করে তিনি গিয়েছিলেন, মালয়েশিয়া। সেখানে ৮ মাস কাজ করেও কোন বেতন পাননি তিনি। উপরন্তু বেতন চাওয়ায় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় বসবাস করছেন রিপন। এরই মাঝে হারিয়েছেন তার মাকে। পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন পরপারে। ছোট্ট দুটি ভাই-বোন দেখবাল করার কেই নেই । বাবা থেকেও নেই । এ অবস্থায় দেশেও ফিরতে পারছেননা তিনি। কারন মালয়েশিয়া সরকার স্পেশাল পাস দিচ্ছেনা। সহসা ইচ্ছে করলেই অবৈধরা দেশে ফিরতে পারছেননা।

একদিকে মায়ের শোক। অন্যদিকে ছোট্ট দুটি ভাই-বোনের চিন্তায় দিন কাটছে রিপনের। ঠিক কি পরিমান অভিবাসী শ্রমিক এধরনের সমস্যার শিকার হয় তার সঠিক কোন সরকারী পরিসংখ্যান না থাকলেও অভিবাসী শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে কাজ করে এমন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে প্রতি বছর এমন প্রতারনার শিকার হয়ে দেশে ফেরে অন্তত ৫০ হাজার শ্রমিক। বাংলাদেশ সরকারের শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে এধরনের প্রতারনার বিরুদ্ধে তারা শক্ত আইন প্রনয়নের কাজ করছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এধরনের প্রতারনার বিরুদ্ধে শুধু আইন প্রনয়নই যথেষ্ট নয়। এখানে দরকার, মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি এবং সে কাজটিও তারা করতে চান। একই সঙ্গে এধরনের প্রতারনা রোধে, সরকারীভাবে রেজিষ্ট্রেশনের যে ব্যবস্থা আছে সেটিকেও কাজে লাগাতে চান সংশ্লিষ্টরা।

মালয়া ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক খালেদ শুকরান বলেন,‘এ প্রতারণার দায়ভার কেবল দালালদের কাঁধে দেয়ার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রকেও এর দায় নিতে হবে। কোথায় কীভাবে মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে তা খুঁজে সমাধান করতে হবে তাদের। বিদেশে যেতে ব্যর্থ শতকরা ১৯ ভাগকে শূন্যতে নামিয়ে আনতে হবে। কারণ বিলেতফেরত বাংলাদেশিদের সংখ্যাও এখন অনেক বড়।’

বিদেশ থেকে ফেরার পর তাদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যাংক ঋণসহ অন্যান্য সহযোগিতা দেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন এ গবেষক। এজন্য আন্ত.মন্ত্রণালয় সহযোগিতা বাড়ানো এবং মধ্যস্থতাকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

তেনাগা ইন্ট: ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ার প্রফেসর নওশাদ আমিন বলেন, বিপুলসংখ্যক অভিবাসন-প্রত্যাশীকে পরিকল্পনামাফিক কাজে না লাগালে তারা দেশের বোঝা হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। তার ভাষ্য, ‘অভিবাসন প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটানো প্রয়োজন। এজন্য এ ধরনের গবেষণার তথ্য কাজে লাগবে। তিনি বলেন, ‘যারা স্টুডেন্ট বা ট্যুরিস্ট ভিসায় গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে থেকে যাওয়ায় অবৈধ হয়ে পড়েন এ টিও একটি প্রতারনা।

এ ধরনের প্রতারণা রাতারাতি কমানো যাবে না। রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি দালাল ও এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

যদিও উল্লেখযোগ্যহারে বৈদেশিক কর্মসংস্থানে আগ্রহী কর্মীরা চাকরি নিয়ে বিদেশ যাচ্ছেন, মানসম্মত জনশক্তির কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থা আমরা কতটুকু করতে পেরেছি তা বিবেচনা করা দরকার।

সরকারের বিএমইটি এর তথ্য যাচাই করলে জানা যায় ১৯৭৬ থেকে এ পর্যন্ত যেসব মোট বিদেশগামী কর্মীর প্রায় অর্ধেকই ছিলেন অদক্ষ।

ফলে কর্মসংস্থানের বিপরীতে কাঙ্খিত রেমিটেন্স আনতে আমরা পুরোপুরি সফল হতে পারিনি। যদি আরও বেশি দক্ষ জনশক্তির কর্মসংস্থানের বন্দোবস্ত করা যায় তাহলে রেমিটেন্সের হার অনেক বাড়বে।

এসএইচ-০৯/১৪/১২ (প্রবাস ডেস্ক)