একজন ভালো মনের মানুষের সন্ধানে

আমি মানুষ না, একজন ভালো মনের মানুষের সন্ধানে বেরিয়েছি। যদি কেউ পরিচয় করিয়ে বা দেখিয়ে দিতে পারে তাহলে বিনিময়ে যা কিছু চাইবে তাই দিতে প্রস্তুত আছি।

এমনটি প্রতিশ্রুতি, এমনটি আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছি কিন্তু ভালো মনের মানুষটির নাগাল মিলছে না। আমার চারপাশে দেখছি, শুনছি ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ, অমানুষ অথচ ভালো মনের মানুষের সন্ধান মিলছে না। কী যে করি?

কেউ ভাল কিছু করলে বা মন্দ কিছু করলে খুব সহজেই আমরা তাকে ভাল বা মন্দ মানুষ বলি। কেউ মানব হয়ে যদি দানবের মত আচরণ করে তখন তাকে অমানবিক কর্মের কারণে অমানুষ বলি। আমরা পৃথিবীর মানুষজাতি খুব সহজেই আমাদের পরিচয়ের আগে টাইটেল দেবার বেলাতে পাকা। যেমন অনেক আগে শুনেছি হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি নামে আমাদের পরিচয়।

পরে শুরু হলো দুর্নীতিবাজ, ধান্দাবাজ, ঘুষখোর, হারামখোর ইত্যাদি। এখন বাংলাদেশের জনগণকে দুই তিনভাগে বিভক্ত করা হয়েছে যেমন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, রাজাকার ইত্যাদি। আমাদের কর্মের ফল বা আচরণ আমাদের পরিচয়।

এটা বুঝতে তেমন অসুবিধা না হবারই কথা কিন্তু ভালো মনের মানুষের ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা কী? এখনও সনাক্ত করতে সক্ষম হতে পারিনি। আমি বেশ ভাবনার ভেতরে। ঠিক তেমন একটি সময় আমার স্ত্রী মারিয়াকে বিষয়টি খুলে বললাম।

সে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে নতুন করে প্রশ্ন করল, তুমি এবং তোমার বন্ধুর ফুটবল হান্ট একাডেমির ব্যাপারে কতদূর কী হলো? তাও একটু বললাম। পরে সে আমাকে আবারও নতুন করে প্রশ্ন করল, কী করতে যদি এমন হতো যে তোমার ছেলেমেয়ে দু’জনই টেনিসের মত ফুটবলের ওপরও পাগল? আমি বললাম একই ব্যবস্থা করতাম যেমনটি করছি টেনিসের জন্য।

আবার প্রশ্ন করল, যাদের জন্য একাডেমি করতে চাচ্ছো তারা কি এমনটি পাগল খেলাধুলোর প্রতি? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি, কারণ আমি সিওর না এখনও। তবে মারিয়া আমাকে নিরুৎসাহিত না করে বরং উৎসাহিত করেছে।

বাংলার নতুন প্রজন্ম সত্যি কি চায় লাল সবুজের পতাকা দেখতে ২০৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলে? যদি নতুন প্রজন্ম সত্যিকারে সেটা চায় এবং তুমি বা তোমার বন্ধু বা যারা এ ধরণের মহৎ কাজে বিনা স্বার্থে তাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করো তাহলে আমি মনে করবো তোমরা ভালো মনের মানুষ। আমি নিঃস্তব্ধে নিরবে আজ শুনলাম আমার সহধর্মীণীর বিশ্লেষণ ভালো মনের মানুষের ওপর।

আজ ভাবছি কেন মারিয়া আমাদের ছেলেমেয়ের সব ট্রফি থেকে শুরু করে তাদের পুরনো টেনিস রাকেট, কাপড়, জুতা এবং টেনিস ব্যাগ সব আফ্রিকাতে প্রতি বছর পাঠায়। শুধু কি তাই? বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষার কাজে বা কারো বিপদে সে কেন সর্বক্ষণ তার হাত বাড়িয়ে দেয়। আমার করার কারণ আমি বাংলাদেশি। আমার অবলিগেশন থাকতে পারে কিন্তু আমার স্ত্রী? তার করার কারণ কী? আমার স্ত্রী হবার কারণে? ঠিক আছে সে বাংলাদেশের জন্য করে বুঝলাম কিন্তু আফ্রিকাতে কেন?

সে কি তাহলে অন্য সবার থেকে ভিন্ন? সে কি তাহলে ভালো মনের মানুষ? সে তার লাস্ট ভিজিটে যখন বাংলাদেশে গিয়েছিল, কেন তার নিজের গলার সোনার হার এবং আংটি কাজের মেয়েটিকে দিয়েছিল?

যে মাত্র দুদিন তাকে আমার বাবা-মার বাড়িতে সেবা করেছিল। একটি ১৫ বছরের মেয়ে আমার মারিয়াকে সাহায্য করেছিল দুদিনের জন্য। সে মেয়েটি হাত দিয়ে নাকি মারিয়ার গলার সোনার চেইন ধরে দেখেছিল, তখন মারিয়া তাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার কি এটা পছন্দ? সে নাকি বলেছিল হ্যাঁ। তখন মারিয়া তাকে তার গলার হার এবং আংটি দিয়ে বলেছিল এগুলো তোমার বিয়ের উপহার।

আমি জানতে পেরে কিছুটা রেগে বকা দিয়েছিলাম আমার মারিয়াকে। তখন সে আমাকে বলেছিল দেখো মেয়েটির বাবা-মা গরীব। কিভাবে এ মেয়ের বিয়ে হবে গহনা ছাড়া? আমার জীবনে এমন একটি সুযোগ কখনও আর নাও আসতে পারে তাই সুযোগ যখন এসেছিল তাই তাকে আমার থেকে গিফ্ট হিসাবে ওগুলো দিয়েছিলাম।

এ ঘটনা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল বাংলাদেশের সেই নহাটা গ্রামে ১৯৯৮ সালে। এত বছর পরে মনে পড়ে গেল সেদিনের সেই স্মৃতি, যখন সে আমাকে বুঝিয়ে দিল আজ ভালোমনের মানুষ কী বা কাকে বলে? আমাদের জীবনের বেশির ভাগ সময় এমনটিই হয় যে আমরা নিজের কাছের মানুষের মাঝে থেকেও তাদেরকে ঠিক চিনে উঠতে পারি না বা নিজের ঘরেই রয়েছে এমন হাজারও প্রশ্নের উত্তর যা উপলব্ধি করার মতো মন মানসিকতা না থাকার কারণে তা জানা হয়না বা আমরা বুঝতে পারিনা।

পাঠক আমি এখানে আরেকটি মানুষের চিন্তা চেতনার ওপর তারই কিছু দৈনিক কাজকর্মের ফলাফল তুলে ধরতে চাই। সে আমার এলাকার এক ছোট ভাই। পেশায় সে একটি কলেজের শিক্ষক। বছরখানেক ধরে আমার অনেক সামাজিক কাজের সাথে সে জড়িত। একজন স্কুল শিক্ষক সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর যাবৎ অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন, কিন্তু অবসর গ্রহণের পর তিনি অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছিলেন বেঁচে থাকার তাগিদে।

অবসরে তাঁর পেনশনের সুব্যবস্থাও ছিল না়। কারণ তিনি ছিলেন একজন বেসরকারি শিক্ষক। তিনি অকৃতদার, ফলে তার স্ত্রী-সন্তান কেউ নেই যে তাঁকে সাহায্য করে। ঠিক তেমন একটি সময় মানবতার ডাকে এসেছিল সবার আগে আমার এলাকার এই কলেজ শিক্ষক নাম জুলফিকার আলী। সে প্রায়ই ছুটে আসে সমাজের নানা ধরনের কাজে।

আজ আবার চোখে পড়েছে তার এ লিখাটি যার কিছু অংশ তুলে ধরলাম। ‘ছোট্ট গ্রাম পরমেশ্বরপুর এক সময় ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। এক সময় অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল না। এখন পুরো গ্রামেই মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস। বলতে গেলে রামপদ কাকার পরিবার ছাড়া সে গ্রামে আর কোনো হিন্দুর বসবাস নেই।

রতন বসুর পরিবারটা এখনো আছে বটে, তবে তারা রামপদ বাবুর ছায়াতলেই থাকেন। এখন আর সে ছায়াটি রইলো না। গোবিন্দ দা’র স্ত্রীই রামপদ কাকাকে শেষদিন পর্যন্ত সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। কখনো কষ্টবোধ করেননি।

রামপদ কাকার মৃত্যুতে তারা অভিভাবকহারা হয়ে গেলেন। রামপদ কাকার আত্মা শান্তিতে থাকুক এ কামনা স্রষ্টার কাছে- জুলফিকার আলী।- জুলফিকার কিছুদিন আগেও রবি বিশ্বাস নামে এক অসহায় পল্লী ডাক্তারের চোখের চিকিৎসায় ঠিকই আমার সাথে হাত বাড়িয়েছিল।

জুলফিকারের কাজকর্মে ফুটে ওঠে সে বাংলাদেশে থেকে সমাজের অনেক সুযোগবঞ্চিত, অবহেলিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। তার এমন ধরণের অসাধারণ কর্মের টাইটেল কি তাহলে সে একজন ভালো মনের মানুষ?

আমাদের চিন্তা চেতনার মাঝে আমাদেরকেই খুঁজতে হবে এরকম হাজারও ভালো মনের মানুষকে। তৈরি করতে হবে ভালোবাসার সেতু। গড়তে হবে মনের মাঝে কাছের মানুষগুলোকে। একইসঙ্গে উচিত হবে নিজেকে জানা, নিজের কাছের লোককে জানা, নিজের স্ত্রীকে জানা। সে শুধু যৌনতার মিলন কেন্দ্র নয়।

এ লোকগুলো আমাদের একে অপরের সুখে-দুঃখের সাথী, পরস্পরের অতি বিশ্বাসের নিকটতম বন্ধুও বটে। নিজেকে এবং নিজের কাছের প্রিয়জনকে শুধু একবার নয়, বারবার করে জানতে হবে এবং জানার মনোভাব তৈরি করতে হবে।

ঘৃণা যেমন ঘৃণা বাড়ায়, ভালোবাসা তেমন ভালোবাসা বাড়ায়। এসো ঘৃণা নয়, ভালোবাসি, মন উজাড় করে ভালোবাসি। ভালো মানুষ মানেই সব সময় ভালো মনের মানুষ নয় তবে ভালো মনের মানুষ সব সময় এবং সর্বত্রে ভালো মানুষ।

এসএইচ-০৭/৩১/১৮ (রহমান মৃধা, যুগান্তর)