তরুণ বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা পর্তুগালে সফল

সাগর কন্যার দেশ হিসেবে পরিচিত পর্তুগাল। আটলান্টিকের পাড়ের দেশ পর্তুগালের বেশির ভাগ এলাকা পাহাড়, নদী ও মহাসাগর পরিবেষ্টিত। তবে বাংলাদেশি তথা অভিবাসন প্রত্যাশীদের কাছে এ দেশটি পরিচিতি অন্য কারনে।

এখানে ইউরোপের অনন্য দেশের তুলনায় সহজে বৈধ হওয়া যায়। রয়েছে সল্পসংখ্যক মূলধন বিনিয়োগ করে ভাল ব্যবসা করার সুযোগ। তাই আশির দশক থেকে এখানে বাংলাদেশি অভিবাসীরা আসতে শুরু করে। বর্তমানে পর্তুগালে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশিদের বিশাল এক কমিউনিটি।

সম্রাট, চৌদ্দ বছর আগে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় পা রাখেন ইউরোপের মাটিতে। দীর্ঘদিন সাইপ্রাসে কাটিয়ে ২০১২ সালে পর্তুগালে আসেন বৈধ হওয়ার আশায়। পাশের বাসার প্রতিবেশী এক সুইস পরিবারের সঙ্গে সক্ষতা গড়ে উঠে কিছু দিনের মধ্যে। মাঝে মাঝে প্রতিবেশী সুলভ খোঁজ খবর নিত। একদিন মন খারাপ দেখে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলো এবং তিনি তার সমস্যার কথা জানালেন। ওদের লিসবনে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ছিল এবং তাকে কন্টাক্টসহ একটি কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন যা তাকে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে তাকে পর্তুগালের কাগজ বা বৈধতা পেতে সাহায্য করে।

কাগজপত্র পেয়ে এক মুহূর্ত বসে থাকতে মন চাইলো না তার। স্বপ্ন ছিল ব্যবসা বানিজ্য করে প্রতিষ্ঠিত হবে তাই প্রথমে একটি টুরিস্ট শপ করেন এবং তিনমাসের মধ্যে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হন।

শুরুতে এত বড় ব্যবসায়িক ধাক্কা খাওয়ার পরেও তার মনোবল ভাঙ্গেনি। আবার শুরু করলেন একটি লেডিস সামগ্রীর দোকান নিয়ে পাইকারি ব্যবসা, লিসবনের সবচেয়ে বড় পাইকারি মার্কেটে। প্রথমে ছোট একটি দোকান দিয়ে শুরু এবং পরবর্তীতে একে একে বিশাল তিনটি দোকানের মালিক হলেন।

দীর্ঘদিন গতানুগতিক ব্যবসা করেছেন এবং গত বছরের শুরুতে চিন্তা করলেন একটু ব্যতিক্রম কিছু করার। অনেক চিন্তা ভাবনা ও তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখলেন পর্তুগাল একটি ট্যুরিজম বান্ধব দেশ। গত বছর ১৫ মিলিয়ন মানুষ পর্তুগাল ভ্রমণ করছে যা এ বছর হবে ১৮ মিলিয়ন। বার্ষিক টুরিস্ট প্রবৃদ্ধি হার প্রায় ১৫ শতাংশ। তাই পরিকল্পনা করলেন এ সেক্টরে কিছু করার।

গত বছর যাত্রা শুরু করে তার ট্যুরিজম কোম্পানি। প্রাথমিক পর্যায়ে উবার, টেক্সিফাই এবং হোটেল মোটেলে গাড়ী সরবরাহ করছেন। পর্যটকদের জন্য অভিজ্ঞ গাইড দিয়ে লিসবনসহ পর্তুগালের গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক স্থান ও শহর সমূহ তুলে ধরার পরিকল্পনা রয়েছে। এখানকার প্রতি পদে পদে ইতিহাস ও ঐতিহ্যে লুকিয়ে রয়েছে। তাই সারা বিশ্ব থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ বেড়াতে আসে।

সম্প্রতি প্রতিষ্ঠা করেছেন পর্তুগাল মাল্টিকালচারাল একাডেমী, যেখান থেকে পর্তুগিজ ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস শিক্ষা কোর্স পরিচালিত হবে। যেখানে লেভেল এ ১ এবং এ ২ সমমানের সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে। উক্ত কোর্সটি পর্তুগাল সরকার কর্তৃক অনুমোদিত এবং পর্তুগিজ নাগরিকত্ব লাভের জন্য অপরিহার্য। ফলে বাংলাদেশিসহ বিশ্বের সব দেশের অভিবাসন প্রত্যাশীরা প্রতি মাসে ভিন্নভিন্ন সময় অনুযায়ী তাদের কোর্সটি সম্পূর্ণ করতে পারবে তার প্রতিষ্ঠান থেকে।

মাহফুজুর রহমান রাসেল ও মাহবুবুর রহমান জিল্লু পর্তুগালের বাংলাদেশি কমিউনিটির অতি পরিচিত ও সুপ্রিয় মুখ। পর্তুগালে পাড়ি জমান দুজনে এক দশক পূর্বে। দেশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা নিয়ে এসে দুজনে শুরু করেছিলেন পাইকারি ব্যবসা। সঠিকভাবে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও পরিশ্রমের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে সফলতা ধরা দিল এবং একে একে পাইকারি ও খুচরো মিলিয়ে লিসবনের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেছেন ছয়টি দোকান।

বাংলাদেশি মানুষের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে যে, যৌথ ব্যবসা ভাল না অথবা দীর্ঘদিন ধরে রাখা যায়না। সেখানে এর ব্যতিক্রম এ যুগল তরুণ ব্যবসায়ীরা। সকলের গতানুগতিক ধারণা পাল্টে দিয়ে তারা হয়ে উঠেন পর্তুগালের সফল ব্যবসায়ীক আইকন। এখন পরিকল্পনা করেছেন এখান বৃহৎ আকারের রিটেইল চেইন শপ করার। যেখানে থাকবে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক, বিভিন্ন পাটজাত পন্য, হস্তশিল্পের নানান রকম পন্য সহ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র।

অপর এক প্রবীণ ব্যবসায়ী মোঃ শাহজাহান, ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ইউরোপে পাড়ি জমান প্রায় তিন দশক আগে ১৯৯১ সালের দিকে। প্রথমে এসেছিলেন বেলজিয়ামে এবং সেখানে কয়েক বছর অবস্থান করার পরে চলে যান পাশের দেশ জার্মানিতে। দীর্ঘদিন জার্মানিতে অবস্থান করেও ভাল কোন সুযোগ সুবিধা করতে পারেন নি। তাই পর্তুগালে চলে আসেন ১৯৯৬ সালে।

ইউরোপে আসার পর থেকে তিনি বিভিন্ন ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট কাজ করেন। ভাল ভাবে রপ্ত করেন ইন্ডিয়ান তথা বাংলাদেশী কারী শিল্পের কলা কৌশল। ইউরোপের সব দেশে বাংলাদেশীরা রেস্টুরেন্ট করলেও তা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট হিসাবে নাম করন করে সহজে পরিচিতি পাওয়ায় জন্যে।

স্টার অব ইন্ডিয়া দিয়ে ১৯৯৯ সালে প্রথম বাংলাদেশি খাবারের রেস্টুরেন্টের সূচনা করেন লিসবন সিটি সেন্টারের প্রান কেন্দ্রে। এই স্থানটিতে সারা বছর পর্যটকের আনাগোনা দেখা যায়, কারন এটি একটি বিশেষায়িত রেস্টুরেন্ট অঞ্চল হিসাবে পরিচিত। তার রেস্টুরেন্টটি প্রায় অর্ধ যুগ চলমান ছিল।

পরবর্তী সময়ে দ্রুত বাংলাদেশিদের রেস্টুরেন্ট ব্যবসার প্রসার বিস্তার ঘটে। বর্তমানে শুধুমাত্র লিসবনে ২৫/৩০ টির অধিক এমন রেস্টুরেন্ট আছে। পর্তুগালের রাজধানী সহ সব বড় বড় শহরে বাংলাদেশিদের রেস্টুরেন্ট ব্যবসা এখন চোখে পড়ার মতো। দু’দশকের মধ্যে আমাদের খাবার পর্তুগিজসহ এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের মনে জায়গাটা দখল করে নিয়েছে।

তারপরে একে একে তিনি তিনটি রেস্টুরেন্ট করেন এবং বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকজন শেফ নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে সেতার নামে অন্য একটি রেস্টুরেন্ট করেন যা এখনো চলমান। সেতার খুব পরিচিত একটি মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট পর্তুগিজদের কাছে। এখানে ফাদো নামে একটি জনপ্রিয় লোকাল মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট আছে। সেতার এবং ফাদো দেখতে কিছুটা একই রকমের তাই স্থানীয় মানুষের কাছে নামটি বেশ পরিচিত।

লিসবনের বাংলাদেশি নানান আঞ্চলিক ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আছেন তিনি। দ্বায়িত্ব পালন করছেন বিয়ানীবাজার ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে। বর্তমানে চিন্তা করছেন দেশে গিয়ে পর্যটন শিল্প নিয়ে কাজ করার। পরিকল্পনা করছেন আন্তর্জাতিক মানের হোটেল, মোটেল ও কটেজ করার সিলেট এবং চট্টগ্রামে।

এসএইচ-০৭/১৯/১৯ (প্রবাস ডেস্ক, তথ্য সূত্র : যুগান্তর)