বাংলাদেশিদের নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায়

ইতালির পথে সহস্রাধিক বাংলাদেশি, লিবিয়ায় নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায়

ইউরোপের দেশ ইতালিতে অবৈধ ভাবে প্রবেশের উদ্দেশে লিবিয়ায় পাড়ি জমায় ভৈরব উপজেলার বিভিন্ন এলাকার সহস্রাধিক যুবক। কিন্তু স্বপ্নের দেশ ইতালি পাড়ি জমাতে গিয়ে লিবিয়ায় বাংলাদেশি দালালচক্রের প্রতারণার শিকার হয়ে নিঃস্ব হচ্ছে শত শত গরীব পরিবার। এসব যুবককে উল্টো করে ঝুলিয়ে রড দিয়ে পিটিয়ে তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে ভৈরব থেকে সহস্রাধিক যুবক লিবিয়ার বিভিন্ন শহরের অবস্থান নেয়। ওই যুবকদের কিছু সংখ্যক দালালদেরকে মোটা অংকের টাকা দিতে নৌ-পথে চোরাইভাবে ইতালি পৌঁছিয়ে দিলেও বেশিরভাগ যুবকই ইতালিতে প্রবেশের পথ মিলছে না। ইতালিতে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে লিবিয়াতে আটকে থাকা যুবকদের জিম্মি করে বাংলাদেশে তাদের পরিবারে কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কয়েক দফায় লাখ লাখ টাকা। দালালদের কাছে আটক থাকা ভৈরবের স্বপ্নভঙ্গ যুবকদের অনেকই টাকার বিনিময়ে মুক্তি পেয়ে লিবিয়া থেকে ফেরত আসছে দেশে।

লিবিয়া থেকে ফেরত ও আটককৃত যুবকদের পরিবারের অভিযোগ, ভৈরবের কতিপয় দালালচক্র অল্প টাকায় ইতালি পাঠানোর কথা বলে লিবিয়ায় পাঠানোর পর ওই চক্রের সদস্যরা তাদের জিম্মি করে শারীরিক নির্যাতনসহ পরিবারের কাছ থেকে কয়েক দফা টাকা আদায় করে থাকে। এমন অভিযোগ লিবিয়ায় আটককৃত ও ফেরত আসা ভৈরবের ভোক্তভোগী পরিবারের।

সম্প্রতি ভৈরব পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকার আকাশ, জুম্মন, শুভ, বাদশা, শাওন, ছালমান, সারুফ, আছিফ ও পিয়ার হোসেনসহ আরো বেশ কয়েকজন লিবিয়ায় বাংলাদেশি দালালচক্রের জিম্মিদশা থেকে মুক্তিপণের টাকা দিয়ে দেশে ফেরত আসে। তারা জানায়, আমাদের লিবিয়ায় পাঠানোর পর লিবিয়ায় অবস্থারত ভৈরবের দালাল আমাদেরকে আটক করে রাখে। পরে আমাদেরকে লোহার রড দিয়ে নির্মম নির্যাতন করে রক্তাক্ত করার চিত্র পরিবারের কাছে পাঠায়। এমন দৃশ্য দেখে আমাদের বাবা-মা সন্তানদের বাঁচাতে লিবিয়ার দালালদের কথামতো বাংলাদেশি দালালদের হাতে মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করতে বাধ্য হয়।

এসব অমানবিক ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে ভৈরবের বিভিন্ন গ্রামের বেশ কয়েকজন দালালের নাম পাওয়া গেছে ভুক্তভোগীদের অভিযোগে। অভিযুক্ত দালালদের মধ্যে রয়েছে ভৈরব পৌর এলাকার জুুয়েল, মানিক, জাফর, উজ্জল ও পার্শ্ববর্তী জেলা নরসিংদীর বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার সহিদ মিয়া, সিলেটের শাহাবুদ্দিন, চট্টগ্রামের মুসলিমসহ আরো বেশ কয়েকজন। ওই চক্রটি বাংলাদেশ ও লিবিয়া অবস্থান করে ইতালি পাঠানোর নাম করে দীর্ঘদিন ধরে লিবিয়ায় অবস্থানরত যুবকদেরকে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করছে। দালালরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছে না ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।

লিবিয়ায় আটক উপজেলার গোছামারা গ্রামের দ্বীন ইসলাম, বায়াজীদ ও সারওয়ারের বাড়িতে সরেজমিনে গেলে দ্বীন ইসলামের বাবা আজাহার মিয়া জানান, ‘আমার ছেলেকে লিবিয়ায় শাহাবুদ্দিন লিবিয়ানদের সাথে মিলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে মেরে ফেলতে চাইলে জীবন বাঁচাতে আমাকে ফোন দেয় বাড়ি থেকে টাকা পাঠানোর জন্য। দালাল উজ্জলকে ৩ হাজার দিনার দেয়ার কিছুদিন পর আবারো আটক করে তার ছেলেকে। ছেলেকে ছাড়াতে হলে পিন্টু ২০ হাজার দিনার দাবি করে। তার কথামতো আমার ছেলেকে ছাড়াতে লিবিয়ায় ১০ হাজার দিনার ও দ্বীন ইসলামের মা আমেনা বেগম বাংলাদেশে পিন্টুর স্ত্রীর কাছে ১ লাখ টাকা পরিশোধ করার পর ছাড়া পায়।

আউয়াল মিয়া জানান, পৌর শহরের তাঁতারকান্দি এলাকার জুয়েলের মাধ্যমে আমার ছেলেকে ইতালির উদ্দেশে দেড় বছর আগে লিবিয়া পাঠায়। লিবিয়া যাওয়ার পর বাংলাদেশি দালাল শাহাব উদ্দিন ও পিন্টু ডাংকির মাধ্যমে ইতালি পাঠাবে বলে আমার ছেলেকে আটকিয়ে রেখে মারধর করে। এ পর্যন্ত তিনবার আমার ছেলেকে তারা আটকে রাখলে বাড়ি থেকে পিন্টুর বউকে ১ লাখসহ মোট ৭ লাখ টাকা তাদেরকে দেয়া হয়। শেষবারের টাকা নিয়ে আমার ছেলেকে ইতালী না পাঠিয়ে পিন্টু সে নিজেই লিবিয়া থেকে ইতালি চলে যায়। আমি এখন দেনার দায়ে ভিটেমাটি ছাড়া। দেনার দায়ে আমার মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপায় নাই।

ভুক্তভোগী দেলোয়ার জানান, আমার ভাই সারোয়ার লিবিয়ায় কাজ করতো। পিন্টু আমার ছোটভাই সারওয়ারকে ইতালি পাঠানোর কথা বলে ১ লাখ টাকা নেয়ার পর ওইখানে মাফিয়ার কাছে বিক্রি করে দেয়। আমার ভাইকে রুমে আটকে রেখে উল্টো ঝুলিয়ে রড দিয়ে নির্যাতন করা হয়। আমার ভাইকে বাচাতে ধারদেনা করে আরো ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাঠালে আমার ভাই ছাড়া পায়।

পঞ্চবটি এলাকার ঝুমুর বেগম জানান, ‘আমি বিধবা মহিলা। চার সন্তান নিয়ে সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালাই। আমার স্বামীর দেয়া স্বর্ণালংকার বিক্রিসহ ধারদেনা করে দালাল জুয়েলের কথায় লিবিয়া পর্যন্ত সাড়ে ৪ লাখ টাকার চুক্তি হয়। সে লিবিয়া থেকে ইতালি পাঠাতে লিবিয়ায় শহীদ নামে দালাল দেড় লাখ টাকায় ইতালি পাঠানোর কথা বললে আমি আমার একটু জায়গা বিক্রি করে শহীদের কথামত শহীদের বউ ও আরাফাত নামে একজনকে ভৈরববাজারে গিয়ে দেড় লাখ টাকা দিয়ে আসি। আমার প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকা খরচ হয়। আমি এখন আমার সন্তানদের নিয়ে দিশেহারা হয়ে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছি। দালালরা তো সুখেই আছে।

ভুক্তভোগী পিয়ার হোসেন জানান, ‘পাসপোর্টের সাথে ৫০ হাজার টাকা এবং লিবিয়া পৌঁছার পর ৪ লাখ টাকায় আমাকে ইতালি নিবে বলে খোকনের সাথে মৌখিক চুক্তি হয়। আমি লিবিয়া পৌঁছানোর পর সম্পূর্ণ টাকা আমার পরিবারের লোকজন খোকনকে পরিশোধ করে দেয়। খোকন সমস্থ টাকা বুঝে পাওয়ার পরও লিবিয়ার দালালদেরকে তাদের পাওনা টাকা না দেয়ায় সেখানকার দালাল রাসেল ও খোকনের সহযোগী মুসলিমসহ অজ্ঞাতনামা দালালরা আমাকে একটি নির্জন বাড়িতে আটকে রাখে। সেখানে আটকে রেখে আমাকে ছয় দিন নির্যাতন করা হয়। ছয় দিন পর খোকন লিবিয়ায় রাসেলকে টাকা দেয়ার পর আমাকে ছেড়ে দেয়। আমাকে ইতালি পাঠানো তো দূরের কথা সে আমাকে লিবিয়ার বেনগাজী থেকে ত্রিপোলিও পাঠায়নি।

পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো: ফজলু মিয়া বলেন, ‘ভুক্তভোগীর অনেকেই আমার কাছে দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। উজ্জলসহ অনেকেই জড়িত রয়েছে বলে শুনেছি। অভিযোগের ভিত্তিতে দরবার করে অনেকের আংশিক টাকাও উদ্ধার করে দিয়েছি। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের সত্যতার ভিত্তিতে অভিযুক্ত দালালদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করতে চেষ্টা করবেন বলে জানান তিনি।

ভৈরব থানার ওসি (তদন্ত) মোখলেছুর রহমান বলেন, ভৈরবে একটি দালাল চক্র লিবিয়া দিয়ে ইতালি পাঠাবে বলে মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছে। তারা ইতালিতে না পাঠিয়ে লিবিয়ার দালালদের সাথে আঁতাত করে ওইখানে আটক করে মাফিয়ার দ্বারা অপহরণের কথা বলে ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছ থেকে আদায় করছে মুক্তিপণের টাকা। বিষয়টি আমরা জানতে পেরেছি। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ভৈরব উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইসরাত সাদমীন বলেন, অবৈধভাবে মানব পাচার অত্যন্ত গর্হিত একটি কাজ। আমি বিষয়টি সম্পর্কে শুনেছি। যারা অবৈধ মানব পাচারের সাথে জড়িত, বিস্তারিত খোঁজখবর নিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান তিনি।

এসএইচ-০৭/২০/১৯ (প্রবাস ডেস্ক)