আষাঢ়-শ্রাবণ বনাম সুইডেনের প্লাস তাপমাত্রা

কয়েকদিন ধরে ভালো তুষার পড়ছিল স্টকহোমে। শহরটি দেখতে হয়েছিল সাদা ধবধবে। শনিবার থেকে তাপমাত্রা প্লাসে থাকায় সবে বরফ গলতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা দেশে বরফ যখন গলতে শুরু করে, তখন মনে পড়ে বাংলাদেশের সেই আষাঢ় শ্রাবণ মাসের কথা।

কাদা ভরা রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় ঝর ঝর করে বৃষ্টি ঝরত। পুরনো সেই স্মৃতিগুলো আজ মনে পড়ে গেল। হাঁটু সমান বরফে রাস্তা ভরা, একই সঙ্গে ঝর ঝর করে বৃষ্টি পড়ছে তুষারের মত করে। সব কিছু মিলে ন্যাস্টি ওয়েদার হয়েছে। এই তুষারের কাদা আর ভাল লাগছে না।

মারিয়া (আমার স্ত্রী) অফিস থেকে বাসাতে এসে বললো, কাল সকালে ইন্ডিয়া যেতে হবে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়েছি। প্রথমে গোয়া পরে আগ্রার তাজমহল ভ্রমণ শেষে ফিরব স্টকহোম। আমি বললাম, তুমি টিকিট কনফার্ম করেছ? সে বললো, হ্যাঁ।

আমি বললাম, ভিসার ব্যাপার রয়েছে, ঝামেলা হবে তো। মারিয়া জানালো তার বন্ধু দিল্লিতে সুইডিস দূতাবাসের প্রথম সেক্রেটারি, তারাও আগামীকাল গোয়া আসছে এবং এয়ারপোর্টে আমাদের রিসিভ করবে। গোয়া বিমানবন্দরে আমাদের ভিসা নিতে হবে। আমি আমাদের পাসপোর্টের ডিটেলস ই-মেইল করে দিয়েছি।

আমাকে একটু সারপ্রাইজ দিতে এ প্ল্যান তার। কারণ কয়েকদিন আগে আমার আবার জন্মদিন গেল। কিছু একটা তো করতে হবে!

অ্যাপোলো টুরিস্ট সার্ভিসের মাধ্যমে স্টকহোম আরল্যান্ডা এয়ারপোর্ট থেকে রওনা দিলাম গোয়ার উদ্দেশ্যে। টানা দশ ঘণ্টার জার্নি। সকাল হতেই ল্যান্ড করলাম গোয়া। হোটেল গ্রান্ড হায়াতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে কারিনা এবং পিটার। কারিনা মারিয়ার বান্ধবী।
বামবোলিম বিচের ধারে অবস্থিত হোটেল গ্রান্ড হায়াত। সোনালী কঙ্কন উপকূলে আরব সাগরজুড়ে বিখ্যাত গোয়া অবস্থিত।

জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলাম সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে। অন্যদিকে রয়েছে বিশাল বাগান, বাগান ভরা নারিকেল গাছ, সঙ্গে নানা ধরণের ফুলের বাহার। বেশ লাগছে, মন্দ নয়।

রোববার সন্ধ্যায়  চলে গেলাম পার্টিতে। নানা ধরণের লোকের আগমন, পরিচয় পর্বের সঙ্গে চলছে কিছুটা রাজকীয় অতিথি আপ্যায়ন।

গালা ডিনারের সঙ্গে রয়েছে বলিউডের নাচগান, যা সন্ধ্যাকে করেছে মনোরম বিনোদনের এক আনন্দময় পরিবেশ। বলিউডের কয়েকজন নতুন তারকারও সেখানে রয়েছে; জানালেন এক কলকাতার বাঙ্গালী।

ইন্ডিয়ান ছবি দেখা বা ফলোআপ না থাকার কারণে বিষয়টি তেমন চোখে পড়েনি, তাই কলকাতার বাবুর মত আপ্লুত হতে পারিনি। রাত বেশ হয়েছে, এদিকে গতকাল সারা রাত প্লেনে কেটেছে, বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

কারিনা এবং পিটারেরও একই অবস্থা। তাই ডিনার শেষে বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। ভালো একটি টানা ঘুম দিয়ে সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম গোয়া ট্যুরে। বেশ ঘোরাঘুরির সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা চলতে সকাল শেষে দুপুর হয়ে গেল। পরে সাগরের পাড়ে কাকরা ভিলেজে এসে লাঞ্চ সেরে নিলাম। পরে আরব সাগরে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে সন্ধায় হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।

ইন্ডিয়ার এক বড় ব্যবসায়ী যার এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসা রয়েছে সুইডেনের সঙ্গে, রাতের ডিনার হবে সেখানে। নানা ধরণের সি-ফুডের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারিনা এবং পিটার ইন্ডিয়ান আতিথেয়তার সঙ্গে যতটা পরিচিত ততটা আমি এবং মারিয়া নই।

কারণ এটা আমার এবং মারিয়ার জন্য প্রথম ভ্রমণ ইন্ডিয়াতে। যদিও গোয়া ইন্ডিয়ায়, তবে সব দেখে মনে হচ্ছে কাইন্ড অফ ইউরোপের ছোঁয়া রয়েছে এখানে। যাইহোক কাল ট্রেনে করে আগ্রা যেতে হবে। তখন নিশ্চয় ইন্ডিয়াকে দেখতে দেখতে পৌঁছে যাব সেই ভালোবাসার প্রাসাদ তাজমহলে।

সকালে এক্সপ্রেস ট্রেনে করে রওনা দিলাম আগ্রার উদ্দেশ্যে। দুই ঘণ্টার জার্নি। বসেছি জানালার পাশে, বেশ চলছে ট্রেন। আগ্রা ট্রেন স্টেশনে পৌঁছে টাক্সি করে সরাসরি রওনা দিলাম সেই বহু আলোচিত তাজমহলের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম তাজমহলের সামনে।

বেশ লোকের ভিড় জমে গেলো আমাদের চারপাশে। কারিনা এবং পিটার সঙ্গে থাকায় ভিআইপি সার্ভিসের মাধ্যমে ভিতরে ঢুকে গেলাম। ঘুরছি আর দেখছি সেই না দেখা পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের এক বিস্ময়কর নিদর্শন তাজমহল। দেখছি হাজার বছরের ভালোবাসার স্মৃতি, যেখানে রয়েছে প্রেম প্রীতি আর ভালোবাসার ছোয়া, সঙ্গে আমার সহধর্মিনী মারিয়া।

হয়ত হবে না গড়া অট্টালিকার তাজমহল, তবে ক্ষতি কি গড়তে ভালোবাসার তাজমহল? মনের মাজারে দুজনে দুজনার জন্য। যখন এমন এক অনুভূতির মাঝে স্বপ্ন চরণে মেতে আছি গভীর নিদ্রায়, ঠিক তখনই ঘড়ি বেজে উঠল। ঘড়িতে এলার্ম দেয়া ছিল সকাল ছয়টা। মারিয়া তার হাতটি আমার শরীরে বোলাতেই হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল।

সকাল সাতটায় জনাথানের (জনাথান আমাদের ছেলে, টেনিস খেলোয়াড়) হাঁটুর অপারেশন হবে। বেশ কিছুদিন ধরে হাঁটুতে ব্যাথা চলছে। একটু অস্থির সবাই, তা সত্ত্বেও সিদ্ধান্তে এসেছি অপারেশন ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।

হাঁটুর মুভমেন্ট বিভিন্ন এঙ্গেলে হওয়ার কারণে ফুটবল, ভলিবল বা টেনিস খেলোয়াড়দের সাধারণত jumper’s knee injury হয়ে থাকে। যার কারণে হাঁটু এবং হাঁটুর ভেতরের নার্ভ সিস্টেমে ইরিটেশন এবং ব্যাথার সৃষ্টি হয়। তাই এই অপারেশন। ছয় থেকে আট সপ্তাহ মত লাগবে সব ঠিক হতে। আমি জনাথানকে নিয়ে স্টকহোম এলারিস সাব্বসবার্গ হাসপাতালে এসেছি। জনাথান চলে গেল অপারেশন রুমে। আর আমি বসে আছি ওয়েটিং রুমে, ঠিক তখন গতকাল মাঝ রাতের সেই ঘুমের ঘোরে স্বপ্নের রাজ্যে গোয়া সঙ্গে তাজমহল ভ্রমণের কথা মনে পড়ে গেল, তাই এই লেখনী।

ফের হঠাৎ কারিনা ফোন করেছিল জনাথনের অপারেশন হয়েছে তাই। রাতের স্বপ্নের ঘটনা আলোচনা করতেই নাছোড়বান্দা ধরেছে আমাদের যেতেই হবে দিল্লিতে। ওরা সেখানে থাকবে কয়েক বছর, তাই বলেছি আসব বেড়াতে, তবে কবে আসব তা বলিনি এখনও।

এসএইচ-০৬/১১/১৯ (প্রবাস ডেস্ক)