বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বাড়ছে ফিনল্যান্ডে

বাংলাদেশি ছাত্রদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য আশির দশকের প্রথমার্ধ থেকে ফিনল্যান্ডে আসা শুরু হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশি ছাত্রদের কাছে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ফিনল্যান্ড বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশে পরিণত হয়েছে। যার ফলে প্রতি বছর বর্ধিত হারে বাংলাদেশি ছাত্র ফিনল্যান্ডের বিভিন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, ডক্টরেট এবং পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি নিতে আসছে।

বাংলাদেশ থেকে সাধারণত চারভাবে ছাত্ররা ফিনল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছে যেমন- ১. কেউ কেউ আসছে নিজ চেষ্টায় তথ্য সংগ্রহ করে এবং নিজে নিজেই কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঙ্ক্ষিত বিষয়ে দরখাস্ত করে; ২. কেউ আবার আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে; ৩. অনেকে আবার শিক্ষা পরামর্শক বা অ্যাডুকেশন কনসালট্যান্টের মাধ্যমে; এবং ৪.

যারা সরাসরি কোনো কারণে ফিনল্যান্ডের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না তারা প্রথমে আসছে ফিনল্যান্ডের পার্শ্ববর্তী কোনো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরবর্তী সময়ে ফিনল্যান্ডের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন। বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য ফিনল্যান্ডে আসছে তারা পড়াশুনা শেষ করে প্রায় সবাই ফিনল্যান্ডে স্থায়ীভাবে থেকে যাচ্ছেন।

প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্ম প্রায় নয় থেকে দশ হাজারের মতো বাংলাদেশির আবাস ফিনল্যান্ডে। ফিনল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলেও প্রায় ছয় থেকে সাত হাজারের মতো বাংলাদেশির আবাসস্থল হচ্ছে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে। অবশিষ্টরা থাকেন ফিনল্যান্ডের অন্যান্য শহরে। তাম্পেরে, তুরকু, লাহতি, ভাসা, রোভানিয়েমি, কোক্কোলা, পিয়েতেরসারি, অউলু, ইউভাসকুলা, মিক্কেলি, ইওয়েনছু এবং কুয়ুওপিও।

যে কারো কাছেই দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যাওয়াটা অনেক বড় সিদ্ধান্ত, তাই এ সিদ্ধান্তটা অনেক কিছু ভেবে-চিন্তে এবং সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নেয়া উচিত। অনেক সময় ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ভুল সিদ্ধান্তে বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে অনেককেই অনেক বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। আমার এ লেখাটা ফিনল্যান্ড সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণা দিবে তাদের জন্য যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ফিনল্যান্ডে আসার কথা ভাবছেন।

এক বাক্যে বলা যায়, ফিনিশ শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বমানের এবং উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর। ফিনিশ শিক্ষা খাত সম্পূর্ণটাই সরকারি মালিকানাধীন। এখানে বেসরকারি খাতের কোনো স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এখানে খুবই ঘনিষ্ঠ। একজন ছাত্র অনায়াসেই তার শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষা সংক্রান্ত যে কোনো ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করতে পারে। শিক্ষকরা এখানে খুবই সহায়ক ছাত্রদের যে কোনো সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে। ২০১৫ সালের চওঝঅ গবেষণা অনুসারে ফিনিশ স্কুল সিস্টেম বিশ্বের সেরা স্কুল সিস্টেমগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে প্রথম শ্রেণী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছাত্র-শিক্ষক সবাই একে অপরকে নাম ধরে সম্বোধন করে।

ফিনল্যান্ডে নিজের মা, বাবা, নানা, নানি, দাদা এবং দাদি ছাড়া সাধারণত সব ক্ষেত্রেই সবাই একে অপরকে নাম ধরে সম্বোধন করে। এখানে শিক্ষককে বা যে কোনো অফিসিয়ালকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করার কোনো রেওয়াজ নেই। কেউ যদি উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য ফিনল্যান্ডে আসার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন, আমি বলব এটা সঠিক সিদ্ধান্ত।

ফিনিশ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ছাত্রদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশুনার ওপর কোনো টিউশন ফিস নেই, কিন্তু এর বাইরের ছাত্রদের জন্য টিউশন ফিস প্রয়োজন। বাৎসরিক টিউশন ফিস সাধারণত আট থেকে বারো হাজার ইউরোর মধ্যে কিন্তু রোজাল্টের ওপর ভিত্তি করে অনেক সময় বৃত্তি পাওয়া যায় অথবা টিউশন ফিসে অর্ধেক বা সম্পূর্ণ মওকুফ পাওয়া যায়।

বিস্তারিত তথ্যের জন্য আপনার কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স পর্যায়ে টিউশন ফিস থাকলেও পিএইচডি ডিগ্রি করতে কোনো টিউশন ফিস লাগে না। অধিকন্তু, গবেষণার পরিকল্পনা ভালো হলে মোটা অঙ্কের বৃত্তি পাওয়া যায়। যে কোনো বিষয়ে পড়াশোনা করতেই আপনি ফিনল্যান্ড আসতে পারেন। তবে পড়াশুনার পর এখানে চাকরি পেতে হলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হবে।

এখানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্র্যাজুয়েটদের চাহিদা খুব বেশি। গুগলে গিয়ে সার্চ দিলে ফিনল্যান্ডের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেটাবেজ পেয়ে যাবেন। যেখান থেকে আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে পারবেন। ফিনল্যান্ডের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স পর্যায়ে আবেদন করার সময় জানুয়ারি মাস। পিএইচডি পর্যায়ে বছরের দুবার অ্যাপ্লাই করা যায়। বিষয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে TOEFL, IELTS বা SAT চাওয়া হয় ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা নিশ্চিতের জন্য।

ফিনিশ শিক্ষাব্যবস্থা খুব বাস্তবভিত্তিক বা প্র্যাকটিক্যাল যা আপনাকে ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রের জন্য উপযোগী করে গড়ে তুলতে সক্ষম। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রতিটা ছাত্র সপ্তাহে পাঁচ কর্ম দিবসে মোট বিশ ঘণ্টা খণ্ডকালীন কাজের অনুমতি পায়। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে যেমন শনি এবং রোববার পূর্ণ দিবস বা আট ঘণ্টা কর্ম অনুমতি পাওয়া যায়। একই ভাবে গ্রীষ্ম এবং শীতকালীন ছুটিতেও আপনি পূর্ণ দিবস কাজ করতে পারবেন। মনে রাখবেন যে কাজ করতে গিয়ে পড়াশুনার ক্ষতি হলে অনেক সময় পুলিশ ভিসা বাড়াতে অসুবিধা করে। বিদেশি ছাত্ররা সাধারণত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং খাবার ডেলিভারির কাজই বেশি করে। খণ্ডকালীন কাজ খুব সহজলভ্য না হলেও এক সময় সব বিদেশি ছাত্রই তা পায়, পার্থক্য শুধু এই যে কেউ একটু আগে পায় আর কেউ একটু পরে পায়।

এসএইচ-১১/২৯/১৯ (প্রবাস ডেস্ক)