রোহিঙ্গা নারীদের মূল টার্গেট মালয়েশিয়া!

বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনেকে ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রপথে নৌকায় করে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন।

পুলিশ বলেছে, দালালরা রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে বঙ্গোপসাগর দিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রুট ব্যবহার করে পাচারের চেষ্টা চালায়।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনেকে বলেছেন, মেয়ের বিয়ে দিতে এবং বাংলাদেশের ক্যাম্পের চেয়ে আরও ভাল থাকার জন্য তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেন।

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে ১১লাখের বেশি রোহিঙ্গা টেকনাফ এবং উখিয়ায় ৩০টির বেশি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে আছেন। কয়েকবছর ধরে রোহিঙ্গাদের বিশেষ করে তাদের নারীদের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। দালালরাও রোহিঙ্গাদেরকেই টার্গেট করছে।

টেকনাফের একাধিক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এমন তথ্য জানিয়েছেন।

কক্সবাজারের পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের অনেকের আত্নীয় স্বজন মালয়েশিয়ায় থাকেন, তারাই টেকনাফ এবং উখিয়ায় বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা তাদের স্বজনদের সমুদ্রপথে অবৈধভাবে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পাচারকারি দালালরাও এই সুযোগ নিচ্ছে। বিভিন্ন সময় উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা এবং আটক দালালদের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তত্য পাওয়ার কথা পুলিশ উল্লেখ করছে।

টেকনাফ এবং উখিয়ায় দু’টি বড় ক্যাম্পের কয়েকজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাথে টেলিফোনে কথা হয়। তারা জানিয়েছেন, অনেক রোহিঙ্গা পুরুষ মালয়েশিয়ায় আছেন, তারা বিয়ে করার জন্য আত্নীয়স্বজন বা পছন্দের মেয়েকে খরচ দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এভাবে অনেক নারী মালয়েশিয়া গিয়ে সেখানে বিয়ের পর সংসার করছে। এধরণের খবর তারা জানেন।

মুবিনা আকতার নামের একজন রোহিঙ্গা নারী টেকনাফের একটি ক্যাম্প থেকে টেলিফোনে বলছিলেন, “রোহিঙ্গা নারী যারা এখান থেকে মালয়েশিয়া যায়, তারা কেউ কেউ বিয়ের লোভে যায়। কারণ আগে থেকে মেয়ে দেখে রেখেছিল, ছেলে মালয়েশিয়া চলে গেছে। আনেকের স্বামী আগে চলে গেছে, এখন স্ত্রীকে নেয়ার চেষ্টা করে। আবার অনেকে টাকার লোভে যায়। পুরুষরাও অনেকে যায়। কেউ আবার অতিলোভে দালালের খপ্পরে পড়ে মালয়েশিয়ার যাওয়ার চেষ্টা করে।”

টেকনাফ থেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন এনজিও কর্মি বলছিলেন, “মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর রোহিঙ্গাদের শিবিরেই থাকতে হচ্ছে। তারা সেখানে সাহায্য পাচ্ছে। কিন্তু নিজে কাজ করে স্বাধীনভাবে চলার জন্য বা আরও ভাল জীবনের আশায় রোহিঙ্গাদের অনেকে মালয়েশিয়া এবং মধ্য প্রাচ্যেরও বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করে।”

রোহিঙ্গাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, আত্নীয় স্বজন যারা মালয়েশিয়া থাকেন, তারাই দালালদের সাথে যোগাযোগ এবং লেনদেনের সমস্যাগুলো মিটিয়ে থাকেন। তাদের রুট সম্পর্কে কোনো ধারণা দেয়া হয় না।

মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টার সময় ট্রলার ডুবে রোহিঙ্গা নারী এবং শিশুর হতাহতের সর্বশেষ যে ঘটনা ঘটলো গত মঙ্গলবার, সেই ট্রলারটি ছাড়া হয়েছিল টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নে নাফ নদীর একটি পয়েন্ট থেকে।

স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন, তাদের ইউনিয়নের গ্রামগুলো নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের তীরে।এই সুযোগ নিয়ে এবং অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্যে এই গ্রামগুলোর বিভিন্ন পয়েন্ট ব্যবহারের মাত্রা এখন বেড়েছে বলে নানা তথ্য পাওয়ার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন।

বাহারছড়া ইউনিয়নটির কমিউনিটি পুলিশের একজন সদস্য সেলিনা আকতার বলছিলেন, বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের তাদের এলাকায় জড়ো করে ছোট ছোট নৌকার মাধ্যমে গভীর সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।

কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর তৎপরতার কারণে দালালরা প্রতিনিয়ত তাদের রুট এবং কৌশল পাল্টিয়ে থাকে।

“রোহিঙ্গা যাদের আত্নীয় স্বজন মালয়েশিয়ায় আছে, তাদেরকেই পাচারকারীরা বেছে নয়। পরিবারের সদস্যদের মালয়েশিয়ায় স্বজনের কাছে পৌঁছে দেয়াই হচ্ছে পাচারকারির কাজ।সেখানে তারা এখন কৌশল পাল্টিয়েছে। আগে তারা এক জায়গায় লোকজন জড়ো করতো। এখন তা করে না। এখন পাচারকারীরা দৃশ্যের পিছনে থাকে।”

“মালয়েশিয়া থেকে রোহিঙ্গাদের স্বজনরাই সরাসরি টেলিফোনে এখানে পরিবারের সদস্যের সাথে যোগাযোগ করে তাদের গভীর রাতে কোন একটি জায়গায় থাকতে বলে। সেখানে তারা গেলে তখন দালালরা তাদের ছোট নৌকায় করে নাফ নদীর মাঝে নিয়ে বড় নৌকা উঠায়। এরপর মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে।”

পুলিশ সুপার আরও বলেছেন, নাফ নদী থেকে বঙ্গোপসাগরে ঢুকে ছেঁড়া দ্বীপ হয়ে পাচারের চেষ্টা করা হয়।

বিভিন্ন সময় আটক দালালদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের কথা উল্লেখ করে পুলিশ সুপার হোসেন জানান – দালালরা আগে টেকনাফ থেকে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যেত। এখনও সেই রুট ব্যবহারের চেষ্টা করে। অনেক সময় সরাসরি মালয়েশিয়া নিয়ে যায়।

তিনি দাবি করেন, তাদের বিভিন্ন বাহিনীর মানব পাচার বিরোধী অভিযানের কারণে দালালরা প্রতিনিয়ত রুট পাল্টাচ্ছে।

এসএইচ-০৫/১২/২০ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)