ইতালিতে লক্ষাধিক বাংলাদেশী কর্মহীন

ইউরোপের মধ্যে ইতালিতে নভেল করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে। লম্বার্ডি ও ভেনেতো অঞ্চলের অনেক শহরে যোগাযোগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কর্তৃপক্ষ। আগামী দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বিশেষ অনুমতি ছাড়া প্রায় ৫০ হাজার বাসিন্দা এলাকা ছাড়তে পারবে না। সেখানে অনেক ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে সরাসরি কর্মহীন হয়ে পড়েছে দেশটিতে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায় যুক্ত (হকার) কমপক্ষে ১ লাখ বাংলাদেশী।

অন্যদিকে বিভিন্ন চীনা রেস্টুরেন্ট ও নাইট ক্লাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরি হারাতে শুরু করেছেন কুক ও ওয়েটার হিসেবে কাজ করা বাংলাদেশীরা। তাদের অনেকেই এরই মধ্যে দেশে ফিরতে শুরু করেছেন।

দীর্ঘ ১০ বছর ধরে ইতালির মিলানে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করেন মাদারীপুর থেকে যাওয়া প্রিন্স মাহমুদ। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় গত রোববার রেস্টুরেন্ট মালিক তাকে কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। এক সপ্তাহ পর কাজে আসতে বলা হয়েছে তাকে।

প্রিন্স মাহমুদ জানান, করোনাভাইরাসের কারণে মিলান শহরের বড় বড় শপিং মল, রেস্টুরেন্ট এরই মধ্যে বন্ধ ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার। কিন্তু এভাবে কতদিন রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকবে তা জানে না কেউ।

ইতালির মিলানে নানা ধরনের পণ্যের ব্যবসা করেন বাংলাদেশের শুভ আহমেদ। দীর্ঘ ১০ বছর ইতালি থাকার সুবাদে পরিবারকেও সেখানে নিয়ে গেছেন তিনি। করোনাভাইরাস আতঙ্কে এখন ব্যবসায় ধস নেমেছে তার। এদিকে সন্তানদের স্কুলও বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। আতঙ্কের মধ্যে পরিবার নিয়ে সেখানে কোনোভাবেই থাকতে চান না তিনি। এরই মধ্যে দেশে ফেরার টিকিট কিনেছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারো ইতালি ফিরবেন শুভ ।

বিভিন্ন দেশ থেকে ইতালি যাওয়া পর্যটকদের কাছে ইতালিয়ান খাবার বেশ জনপ্রিয়। ফলে পর্যটন এলাকাগুলোতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট। ইতালিয়ান খাবারের পর সবচেয়ে জনপ্রিয় জাপানি খাবার ‘শুশি’। ইতালিতে শুশির জন্য যেসব রেস্টুরেন্ট বিখ্যাত, তার ৯৯ শতাংশই আবার চীনা মালিকানাধীন। চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই এসব রেস্টুরেন্টে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন পর্যটকরা। গত কয়েক দিন ধরে ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টেও কেউ আর খেতে যাচ্ছেন না। ফলে এসব রেস্টুরেন্টে কাজ করা বাংলাদেশীরা এখন কর্মহীন।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে ‘বার’ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে এসেছেন ইতালি প্রবাসী সাইফুল ইসলাম মুন্সি। তিনি মিলানের একটি চীনা মালিকানাধীন বারে কাজ করতেন।

সাইফুল ইসলাম জানান, চীনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই ইতালির বিভিন্ন স্থানে থাকা চাইনিজ মালিকানাধীন বার ও রেস্টুরেন্টগুলো এড়িয়ে চলতে শুরু করেন ভোক্তারা। ফলে শুরুতেই ব্যবসা হারিয়ে বন্ধ হতে শুরু করে সেগুলো। গত কয়েক দিনে ইতালির বিভিন্ন শহরে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়ার পর থেকে ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টগুলোতেও আর কেউ খেতে যাচ্ছেন না। ফলে দেশটিতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা প্রায় বন্ধ। কাজ না থাকার পাশাপাশি ভাইরাস আতঙ্ক বাড়ায় আগামী মে মাস পর্যন্ত দীর্ঘ ছুটি নিয়ে দেশে ফিরেছি।

জানা গেছে, বর্তমানে ইতালিতে ২ লাখ ৬০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছেন। এর মধ্যে ৭৫ হাজার রয়েছেন অবৈধভাবে। অবৈধভাবে যারা আছেন তারা প্রায় প্রত্যেকেই পর্যটনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যবসার (ভ্রাম্যমাণ) সঙ্গে জড়িত। অল্প পুঁজিতে লাভ বেশি হওয়ায় বৈধভাবে থাকা অনেক বাংলাদেশীও সেখানকার পর্যটক অঞ্চলগুলোয় হকারি করেন। সব মিলিয়ে কমপক্ষে দেড় লাখ বাংলাদেশী ইতালিতে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা করেন। কিন্তু করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর পর্যটকরা যেমন আসছেন না, তেমনই ইতালিয়ানরাও প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বের হচ্ছেন না। ফলে হঠাৎ করেই কর্মহীন হয়ে পড়েছেন ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা করা অন্তত এক লাখ বাংলাদেশী।

এদিকে ইতালির যেসব এলাকায় করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটেনি, সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশীরাও খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। এমনই একজন পটুয়াখালীর কলাপাড়া থেকে যাওয়া শহিদুল ইসলাম খোকন। ২০১২ সাল থেকে তিনি ইতালির আরেজ্জো শহরে আছেন। বর্তমানে ‘এসকে সিলভার’ নামে রুপার গহনা তৈরির একটি কারখানা পরিচালনা করছেন তিনি।

তিনি বলেন, আরেজ্জো শহরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নেই, কিন্তু প্রভাব আছে। চীন থেকে আমাদের কাঁচামাল আসত। কিন্তু গত এক মাস ধরে চায়না থেকে আমদানি বন্ধ। গহনার অর্ডারও পাচ্ছি না। আরেকজন পার্টনার ও দুজন কর্মচারীসহ এসকে সিলভার কারখানায় আমরা চারজন বাংলাদেশী। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চললে পুঁজি হারাতে হবে।

ইতালি প্রবাসী বাংলাদেশীরা বলছেন, নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গোটা দেশেই আগামী ২ মার্চ পর্যন্ত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। সবগুলো সুপারশপ বন্ধ করা হয়েছে। এর আগেই পরিবার নিয়ে যেসব বাংলাদেশী আছেন, তারা যতটুকু পেরেছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মজুদ করেছেন। করোনাভাইরাসের আতঙ্কে খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে সুপার মার্কেটগুলোতে। বিশেষ করে আটা, ময়দা ও চাল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রবাসী বাংলাদেশীরা পাস্তা খেয়ে থাকছেন। অন্যদিকে মাস্কের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। তবে ইতালির সরকার আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সবাইকে সাবধানে চলাচল করতে বলেছে তারা। এছাড়া আক্রান্ত এলাকায় বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বের হতে নিষেধ করা হয়েছে।

এসএইচ-০৬/২৯/২০ (প্রবাস ডেস্ক)