ইতালিতে কেমন আছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা?

ইতালি এখন অবরুদ্ধ নগর। পথঘাট জনমানবহীন,খাঁ খাঁ করছে। বিশেষ দরকার ছাড়া কেউ ঘর থেকে বেরুচ্ছে না। সরকার, প্রশাসন থেকে কড়া নির্দেশ জারি করা হয়েছে অদরকারী ঘোরাঘুরি একদম বন্ধ। শাস্তি হিসেবে জেল-জরিমানা করা হচ্ছে।

সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাস চালু করা হয়েছে, যেন ঘরে বসে লেখাপড়ার কাজ চালিয়ে নেয়া যায়। খাবারের দোকানসহ সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ।

অধিকাংশ অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ধর্মপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ভ্যাটিকানের ইতিহাসে গত রোববার প্রথমবারের মতো ক্যাথলিক ধর্মীয়নেতা পোপ তার সাপ্তাহিক বক্তব্য রেখেছেন ভিডিও ক্যামেরার সামনে।

তিনি ভ্যাটিকানের জানালায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেননি। তার বক্তব্য বড় মনিটরে দেখানো হয় সান বাজিলিকো স্কয়ারে উপস্থিত ভক্তদের। যদিও সেখানে ভক্তউপস্থিতি ছিল খুব সামান্য।

শিল্পের দেশ ইতালির অন্যতম বড় আয়ের উৎস পর্যটন ব্যবসা। কোনো কোনো প্রভিন্সের প্রধান আয়ের উৎস পর্যটন খাত। এখন তা একেবারেই বন্ধ। লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে যারা সিজন্যাল ব্যবসা বা চাকরি করেন তাদের জন্য বেকারত্বের ঝুঁকি সব থেকে বেশি।

এর বাইরে ইতালিতে অনেক অভিবাসী আছেন যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই, ছোটখাট কাজ করে কোনোরকমে পেট চালান তাদের জন্য সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এক সপ্তাহ কাজ না করতে পারলে যারা নিজের খরচ জোড়াগ করতে পারেন না তাদের জন্য সময়টা সত্যিই কঠিন।

প্রবাসীদের বড় অংশ নিয়মিত দেশে টাকা পাঠান। যারা প্রতি মাসের বেতন হাতে পেয়ে বা অন্যান্য আয় থেকে নিজের খরচটা রেখে বাকি সব টাকা দেশে পাঠিয়ে দেন, তারাও পড়েছেন বিপাকে। হাতে টাকা না থাকার কারণে তারা এখন নিজের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

এই অচলাবস্থা আরও কিছুদিন চলতে থাকলে মানবেতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইতালিতে প্রতিদিনই করোনাক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সরকার গোটা দেশের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। সব মানুষকে হোম কোয়ারেনটাইনে রাখা হয়েছে। প্রতিটা শহরের প্রবেশ পথে সেনা মোতায়ন করা হয়েছে।

পুলিশের গাড়ি থেকে মাইক বাজিয়ে মানুষকে ঘরে থাকার অনুরোধ করা হচ্ছে। সব সংবাদ মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে দরকারী নিয়ম-কানুন প্রচার করা হচ্ছে। কেউ অসুস্থ বোধ করলে বা করোনার প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দিলে হাসপাতাল বা ব্যক্তিগত চিকিৎসকের কাছে যেতে নিষেধ করা হয়েছে।

প্রত্যেক শহরের জন্য আলাদা হটলাইন চালু করা হয়েছে। ওইসব নাম্বারে ফোন করে অসুস্থতার কথা জানালে পরবর্তি সব ধরনের পদক্ষেপ স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে গ্রহণ করা হচ্ছে।

পরিবারের কোনো সদস্যের মধ্যে ফ্লু জাতীয় রোগের প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দিলে সবার আগে তাকে এক ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়েছে। মাস্ক ব্যবহার করতে বলা হয়েছে।

বারবার বলা হচ্ছে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। এ দুর্যোগ থেকে মুক্ত থাকার আপাতত একটাই উপায়- সতর্ক থাকা, পরিচ্ছন্ন থাকা, পারস্পরিক মেলামেশা বন্ধ রাখা, ঘর থেকে বের না হওয়া এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।

দেশে থাকা ইতালি প্রবাসীদের আত্মীয়-স্বজন চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। প্রতিমুহূর্তে তারা তাদের আপনজনদের খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করছেন। কারো কারো মধ্যে অতিমাত্রায় উদ্বিগ্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশে বলতে চাই- করোনা সংকট শুধু অভিবাসীদের জন্য নয় বা সরকারের কোনো পদক্ষেপই শুধু ইতালীয় নাগরিকদের জন্য নয়।

ইতালির সব নাগরিক এবং অভিবাসী আইন, চিকিৎসা, ব্যবসা, শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকেন। সুতরাং দুশ্চিন্তা না করে আপনার আপনজনকে সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলার পরামর্শ দিন। সাহস দিন এবং দোয়া করুন।

বাংলাদেশে কজন করোনাক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে, যার দু’জন ইতালি অভিবাসী। আমি মনে করি এমন সরকারি ঘোষণা এবং মিডিয়ায় তা প্রচার করা চরম অবিবেচক কাজ হয়েছে।

এর দ্বারা ইতালি প্রবাসীরা এবং দেশে থাকা তাদের আত্মীয়রা মারাত্মক রকম সামাজিক এবং মানষিক চাপে পড়েছেন, যার কিছুটা প্রতিক্রিয়া আমরা ঢাকার হজ ক্যাম্পে দেখেছি।

ইতালিসহ যে সব দেশে করোনা মহামারী আকার ধারণ করেছে সে সব দেশ থেকে বাংলাদেশে যাওয়া সব যাত্রীর অনেক আগে থেকেই ঢাকার এয়ারপোর্টে কোয়ারেনটাইন করা দরকার ছিল। তা যখন সম্ভব হয়নি এখন কোন দেশ থেকে কতজন এসেছেন এবং করোনাক্রান্ত হয়েছেন তা আলাদা করে প্রচার করার মধ্যে বিশেষ কোনো সুবিধা আছে বলে মনে করি না।

বরং এর দ্বারা প্রবাসী এবং তাদের স্বজনদের বাড়তি চাপের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে,হচ্ছে।

করোনা সংক্রমণ বিষয়ে বাংলাদেশের আরও আগে থেকে সতর্ক থাকা দরকার ছিল। প্রযুক্তি আমদানি এবং এর জন্য কিছু মানুষকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার ছিল। কিন্তু সরকারের ভেতরে এ সব বিষয়ে চরম উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

আমাদের সরকারের বোঝা দরকার ছিল ইউরোপের দেশ ইতালিসহ অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ চীন, জাপান, কোরিয়ারা করোনা ঠেকাতে হিমশিহ খাচ্ছে। শত চেষ্টা করেও তারা মহামারী ঠেকাতে পারছে না।

দেশজুড়ে কোয়ারেনটাইন করতে হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের মতো ঘন মানুষের দেশে, স্বল্প সক্ষমতার দেশে এত উদাসীনতা কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য হয় না। মন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষদের কথাবার্তায় আরও বেশি সংযত এবং বিচক্ষণ হওয়া দরকার।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়লে বাংলাদেশে যে কত ভয়াবহরূপ ধারণ করবে তা সাধারণ জনগণ অনুভব করতে না পারলেও সরকারের অনুভব করা উচিত। সুতরাং এখনও সময় ফুরিয়ে যায়নি- রাজনৈতিক সব অনাচার বাদ দিয়ে এ মুহূর্তে এটাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বে নেয়া দরকার।

দেশে সবধরনের সভা-সমাবেশ, ওয়াজ মাহফিল, খেলাধুলা, গ্যাদারিং নিষিদ্ধ করা দরকার। যে সব শহরে করোনা শনাক্ত হয়েছে ওইসব শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা দরকার। প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি সব নাগরিকের কাছে পৌছে দেয়ার বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেয়া দরকার। পর্যাপ্ত খাবার, পানি এবং ওষুদের সরবরাহ রাখা দরকার।

কোনো অসাধু ব্যবসায়ী যাতে করোনা সংকট নিয়ে ব্যবসা করতে না পারে সে বিষয়ে কড়া পদক্ষেপ নেয়া দরকার। ইতালিতে অন্য সময় যদি কেউ অতিরিক্ত দাম নেয় তবে অর্থদণ্ড দেয়া হয়, কিন্তু এমন মানবিক সংকটের সময় কেউ দাম বাড়ালে বা কোনোভাবে বাড়তি মুনাফা করার চেষ্টা করলে তার ব্যবসায়িক লাইসেন্স বাতিল করা হয়, সঙ্গে জেল-জরিমানাও।

দেশের আলেম-ওলামা এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আক্রান্ত এলাকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা উচিত। কারণ মসজিদে সেজদার জায়গা থেকে, কার্পেট থেকে এই ভাইরাস ছড়ানো সম্ভবনা অনেক বেশি।

এসএইচ-০৬/১৭/২০ (প্রবাস ডেস্ক)