কানাডায় নীরবে মরছে বাঙালি শিক্ষার্থীরা!

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে এক স্বপ্নের দেশ, কানাডা। প্রতি বছর অসংখ্য শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য উত্তর আমেরিকার এই দেশটিতে পাড়ি জমান। কিন্তু স্বপ্নের দেশে গিয়ে অনেক সময় কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয় কাউকে কাউকে। পৃথিবীর এই দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্রের জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা কম থাকায় বা অবহেলার কারণে জীবনঝুঁকিতে পড়ছেন অনেকেই। আর নীরবে খালি হচ্ছে কোনো কোনো মায়ের বুক।

নিজেদের জনসংখ্যা ও অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বিদেশিদের নাগরিকত্ব ছাড়াও স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার দিয়ে আসছে কানাডা। ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন করে ১৫ লাখ অভিবাসী নেয়ার পরিকল্পনা করেছে পৃথিবীর শীতলতম এই দেশটি। ফলে বর্তমান বিশ্বে অভিবাসী হতে চাওয়া মানুষের কাছে কানাডা এক স্বপ্নের দেশ। বর্তমানে কানাডায় প্রতি পাঁচজনে একজন অভিবাসী।

কিন্তু এতো কষ্ট করে দেশটিতে গিয়ে জীবনঝুঁকিতে পড়ছেন অনেকে। যার মধ্যে একটি বড় সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী এবং অভিবাসী।

সর্বশেষ গত ২৫ এপ্রিল কানাডার মন্ট্রিয়লে ইয়াসিন মোহাম্মদ খান ফাহিম (২৬) নামে এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধার করে দেশটির পুলিশ। শ্বাসকষ্টজনিত কারণে শ্বাস বন্ধ হয়ে ফাহিমের মৃত্যু হয় বলে জানায় মন্ট্রিয়াল পুলিশ।

স্বপ্নের কানাডায় পড়তে গিয়ে অকালে মৃত্যু হলো ইয়াসিন মোহাম্মদ খান ফাহিম। ছবি: ফেইসবুক থেকে নেয়া

চলতি বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি কানাডায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান বাংলাদেশি তিন শিক্ষার্থী আরিয়ান আলম দীপ্ত, শাহরিয়ার খান মাহির ও আঞ্জেলা বারৈ শ্রেয়া। গুরুতর আহত হন শিল্পী কুমার বিশ্বজিতের ছেলে নিবিড় কুমার।

এর আগে ২০২১ সালের মে মাসে কানাডার অটোয়া শহর থেকে টরন্টোয় ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন তিন প্রবাসী বাংলাদেশি কানাডিয়ান নাগরিক।

সড়ক দুর্ঘটনা বা শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুর খবর মাঝে মধ্যেই শোনা যাচ্ছে কানাডায়। এরপর মরদেহগুলোও কফিনবন্দি হয়ে ফিরে আসে নিজ দেশে, যথারীতি হয় দাফন। কিন্তু বারবার কেন ঘটছে এমন ঘটনা? অসচেতনতা, অবহেলা নাকি দুর্ঘটনা- তাই জানার চেষ্টা করেছে সময় নিউজ।

কানাডায় বসবাসকারীরা এ অপমৃত্যুর জন্য সেখানকার বাংলাদেশি বাড়ির মালিকদের দায়ী করছেন। তারা বলছেন, বাড়ির মালিকদের অবহেলায় বাড়িগুলো হয়ে উঠছে মৃত্যুপাঁদ। এ ছাড়া দেশটির সড়কে চলাচল সম্পর্কে আইন না জানায় অনেকের মৃত্যু হয় দুর্ঘটনায়।

কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ। তিনি প্রায় ১৪ বছর ধরে দেশটিতে বসবাস করছেন।

তার কাছে জানতে চাইলে তিনি সময় সংবাদকে জানান, কানাডার আবহাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার বাড়িগুলোও তৈরি করা হয় সব বিষয় বিবেচনা করে। বাংলাদেশ থেকে যারা দেশটিতে আসেন পড়াশোনা করতে, তারা দক্ষিণ এশিয়ার যে কমিউনিটি সেখানে একটু কম খরচের বাড়িগুলো ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন। আর ওইসব বাড়ির বেশির ভাগের মালিক বাংলাদেশি, ভারত, পাকিস্তান ও চীনের লোকেরা।

এই পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ জানান, এই বাড়িগুলো (কটেজের আদলে তৈরি) অধিকাংশ পুরনো। যেগুলোর বয়স ৮০ থেকে ১৫০ বছর। কম দামে কানাডিয়ানদের কাছ থেকে বাড়িগুলো ৯০ শতাংশের বেশি বাংলাদেশি যারা, স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, তারা কিনে নিয়েছেন।

বাড়ির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি বলেন, এই বাড়িগুলো মূলত দুই বা তিনতলা বিশিষ্ট হয়। বেজমেন্টে একতলা (যেটি মাটির নিচে), আর উপরে একতলা বা দো’তলা। মালিকরা থাকেন উপরের তলায় আর বেজমেন্ট শিক্ষার্থীদের কাছে ভাড়া দিয়ে থাকেন। যে ভাড়ার টাকা দিয়ে মালিকরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেন।

কানাডার কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে বছরের ছয় মাসের বেশি সময় তীব্র শৈত্যপ্রবাহ চলে, যখন তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ থেকে ৪০ ডিগ্রি থাকে। ওই সময়সহ বছরের অধিকাংশ সময় বাড়ির দরজা বা জানালা খোলা হয় না। একেবারে বাতাস প্রবাহ বন্ধ থাকে। আর বেজমেন্টে তো বাইরের বাতাস বা আলো যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ফলে ওই ছোট বাড়িগুলোতে একদিকে অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে, অন্যদিকে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ হয়ে মৃত্যর আশঙ্কা থাকে।

সাধারণত শ্বাস নেয়ার সময় অতিরিক্ত মাত্রায় কার্বন মনোক্সাইড গ্রহণের ফলে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বর্ণ ও গন্ধহীন এই গ্যাস- যার থেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলা, খিঁচুনি, বা মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। আত্মহত্যার চেষ্টা হিসেবে অনেকেই এই গ্যাসের ব্যবহার ঘটায়।

কানাডায় বসবাস করা বাংলাদেশি বা দক্ষিণ এশিয়ার বাড়ির মালিকরা খুব অসৎ হয়- দাবি করে মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, তারা এমনিতেই পুরানো বাড়ি কিনে সেগুলো ভাড়া দেয়। আবার রক্ষণাবেক্ষণ করে না। এমনকি অনেকে বেআইনিভাবে বাড়িগুলো মোডিফাই করে বলেও জানান তিনি।

পলাশ আরও বলেন, বেজমেন্টে গ্যাস লাইন টানা বা রান্না ঘরের কোনো অনুমতি দেয় না সরকার। কারণ, সেখানে আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে না, তাই ওই জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ। আবার প্রতি বাড়িতেই ফায়ার অ্যালার্ম এবং কার্বন মনোক্সাইড অ্যালার্ম লাগানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু মালিকরা বেজমেন্টের মতো বদ্ধ জায়গায় এক্সোস্ট ফ্যান (ভেন্টিলেটরের ফ্যান) লাগিয়ে সেখানে রান্না ঘর করে ভাড়া দিয়েছে। সংযোগ দিয়েছে গ্যাস লাইনেরও। ফলে ওইসব বাড়িতে সবার অজান্তে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস জমা হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

আবার এই বাড়িগুলোতে কার্বন মনোক্সাইড অ্যালার্ম থাকে না বা থাকলেও কাজ করে না জানিয়ে এই পরিবেশবিদ বলেন, ‘আমি যখন শুরুতে কানাডায় এসেছিলাম, তখন ১৫০ বছরের পুরনো একটি বাড়িতে থাকতাম। ওই বাড়িতে এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ার ফলে গলা শুকিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। কিন্তু কার্বন মনোক্সাইড অ্যালার্ম না থাকলে ওই গ্যাসের সৃষ্টি হলেও বুঝার কোন উপায় নেই।’

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আগুন লাগলে যেমন না পুড়লেও অনেকে ধোঁয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান, এখানেও ঠিক তেমন। শীতকালে সবাই ফার্নেস পোড়ানোর মাধ্যমে ঘর গরম রাখে। যেখান থেকে কার্বন মনোক্সাইড নিঃসরণ হয়ে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটায়। কখনও কখনও গাড়ি গরম রাখতে পার্কিং অবস্থায় ইঞ্জিন চালু করে রাখা হয়, তখন ভেতরে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের সৃষ্টি হয়।

মোস্তফা কামাল বলেন, যাদের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা বা ফুসফুসে সমস্যা আছে তাদের জন্য ওইসব বাড়ি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এসব বিষয়ে অনেকেই সতর্ক থাকেন না বা জানেনই না। এজন্য ফায়ার অ্যা লার্ম এবং কার্বন মনোক্সাইড অ্যালার্ম কাজ করে কি না তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি শিক্ষার্থী বা অভিবাসীদের বাসা ভাড়া নেয়ার আগে সব বিবেচনা করে নেয়ার পরামর্শ দেন এই গবেষক।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সায়ীদ আল জামানের সঙ্গে। যিনি দীর্ঘদিন কানাডায় ছিলেন। সদ্য পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছেন তিনি।

তার অভিজ্ঞতা থেকে জানান, শীতের সময় অতিরিক্ত বরফ পড়ার কারণে সব সময় রাস্তা পরিষ্কার করে রাখা যায় না। এতে রাস্তায় ব্ল্যাক আইস জন্মে। কিন্তু খালি চোখে সেটি বোঝা যায় না। ওইগুলো খুবই পিচ্ছিল। যেখানে দাঁড়ানো যায় না বা কোনো গাড়ির ব্রেক কাজ করে না। ফলে দ্রুতগতির একটি গাড়ি যখনই ওই ব্ল্যাক আইস এলাকায় আসে তখনই চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।

তিনি বলেন, রাস্তায় ব্ল্যাক আইস থাকলে সাধারণ কোনো চালকের পক্ষে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব না। খুব দক্ষ চালকের ক্ষেত্রেও গাড়ি নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। যারা আগে থেকে জানে, তারা কিছুটা সতর্কভাবে গাড়ি চালান। কিন্তু যারা জানেন না, তারাই দ্রুত গাড়ি চালাতে গেলে আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে।

এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘আমি ৫ মিনিটে ৫টি দুর্ঘটনা দেখেছি এই ব্ল্যাক আইস এলাকায়। রাস্তার দুই পাশে গাড়িগুলো উল্টে ছিল।’ এজন্য গাড়ি চালানোর সময় রাস্তার নিয়ম মানতে জোর দেন জাবির এই শিক্ষক।

বাংলাদেশ থেকে ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে দুর্ঘটনা ঘটায় দাবি করে সায়ীদ আল জামান জানান, বাংলাদেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী যাওয়ার আগে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে যান। কারণ কানাডায় বাংলাদেশি লাইসেন্স থাকলে তিনি গাড়ি চালাতে পারেন। কিন্তু কানাডায় নতুন চালকদের অনেকগুলো টেস্ট এবং প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিয়ে এরপর লাইসেন্স পেতে হয়, যা অনেক কষ্টসাধ্য। এই সমস্যা এড়াতে ভুলা লাইসেন্স দিয়ে গাড়ি চালান অনেকেই।

.স্বপ্নের কানাডায় পড়তে গিয়ে অকালে মৃত্যু হলো ইয়াসিন মোহাম্মদ খান ফাহিম। ছবি: ফেইসবুক থেকে নেয়া

তিনি বলেন, ‘বালাদেশের রাস্তার অবস্থা আর কানাডার অবস্থা পুরোই আলাদা। যেটি মাথায় রাখতে পারেন না অধিকাংশ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। বরফ জমা রাস্তায় কীভাবে চালাতে হয় তা জানেন না। রাস্তার নিয়মও মানেন না। তারাই এই সমস্যায় বেশি পড়েন।’

এদিকে কানাডায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাউন্সিলর অপর্ণা পাল সদ্য মারা যাওয়া শিক্ষার্থী ফাহিমের পরিবারের খোঁজখবর রাখছেন। মারা যাওয়া শিক্ষার্থী এবং পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘ফাহিমের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা নেই। আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত আছি। মেডিকেল রিপোর্ট পেলেই আমরা ফাহিমের মরদেহ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করব।’

দুঃখ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সন্তানেরা এইদেশে পড়াশোনা করতে এসে সড়ক দুর্ঘটনায় বা একাকীত্বের কারণে মারা যাচ্ছে। এভাবে মৃত্যু আসলে খুবই দুঃখজনক। আমাদের সন্তানদের প্রতি আরও সচেতন হতে হবে এবং দেশের বাইরে বাসায় একা থাকা থেকে বিরত রাখতে হবে।’

ফাহিমের মৃত্যুর চার দিনের মাথায় মারা গেছেন তার বড় চাচা আবু ফজল খান। শুক্রবার রাতে শ্বাসকষ্টের সমস্যায় তিনি মারা যান বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে। শনিবার বাদ আসর জানাজার পরে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে। আর তার পাশেই দাফন করা হবে ফাহিমকে।

এসএইচ-০৩/২৯/২৩ (প্রবাস ডেস্ক. সূত্র : সময়)