ছাত্রজীবনেই বেকারত্ব দুর করা যায়

আমি এমন একটা পরিবারে বড় হয়েছি যেখানে উপার্জন করতেন বাবা। তিনি ছিলেন একজন উপ-সরকারী ইঞ্জিনিয়ার। কখনও তাকে অসৎ উপায়ে টাকা উপার্জন করতে দেখিনি। নিজেরা মানুষ হয়েছি খুব সাধারন ভাবে। মানে মধ্যবিত্ত পরিবার হলে যা হয়। বিলাসিতা কি তা কখনও দেখিনি । বাবা যে শুধু নিজের সংসার দেখতেন, তা না। তিনি তার বাবা মা ভাই বোনদেরকেও দেখতেন। ঠিক তেমনি মা গৃহিনী হলেও তার ভুমিকাও ছিল বাবার অনুরূপ।

যাই হোক সব কিছু ঠিক রেখে বাবা মা কষ্ট করে আমাদের তিন ভাইকেই একাডেমিক গন্ডি পার করিয়েছেন। ব্যাপারটা এমন ছিল যে পঞ্চম শ্রেণী পাস করতে হবে তাহলে হাই স্কুলে ভর্তি হতে পারবে। এস এস সি পাস করতে হবে তাহলে কলেজ ভর্তি হতে পারবে। এইচ এসসি পাস করতে হবে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে ।

সব ধাপেই মোটামোটি পাশ করে গেছি। কিন্তু পাশ করার পর কোথায় যেতে হবে সেটা আর তেমন কেউ বলে দিতে পারেনি বা তারাও সেভাবে কখনও চিন্তা করেননি। তারা ভেবেছিল হয়তবা ছেলে পাশ করে বের হলে নিশ্চয় কিছু একটা হবে । কিন্তু “নিশ্চয় কিছু একটা হওয়া” যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, নিজেরা কোনদিন আচ করতে পারেননি। এমনকি আমিও না । ফলাফল, সামনে যা দেখছি সেটা লাখ লাখ বেকার ছেলে মেয়ে। এখানে যে বাবা মা কে দোষ দেবেন সে সুযোগ খুব কম। কারন, তারা নিজেরাই হয়তবা এত কিছু জানতেন না বা ভাবতেন না।

আবার স্কুল কলেজের শিক্ষকদের দোষ দেবেন, তারা তো নিজের সংসার চালানোর টাকা যোগাড় করার জন্য প্রাইভেট ব্যাচ নিয়েই বেশি ব্যাস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা বলবেন, তারা তো নিজেদের ক্ষমতার দাপট দেখানো নিয়েই বেশি ব্যস্ত। তাদের আর এ ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে চিন্তা করার কি সময় আছে? আর করবেই বা কেন?

কিন্তু একজন স্টুডেন্টের ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারে, কোন দিকে নিজের ক্যারিয়ার গড়লে সে ভাল করবে, কিংবা কি হওয়া উচিৎ? এ বিষয় গুলো নিয়ে শিক্ষক যে ভাবে শিক্ষার্থীদের দিক নির্দেশনা দিতে পারেন, সেভাবে মনে হয় না আর কেউ দিতে পারবেন। আর সকলের বাবা মা তো শিক্ষিত নাও হতে পারে। কিন্তু গুগলে পড়েছি বা দেখেছি উন্নত বিশ্বে কিভাবে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার কাউন্সিলিং করেন। আর সেখানে “হায় আমাদের দেশ”!। ফলাফলের মাধ্যমে ছাত্র জীবন শেষ, শুরু বেকার জীবন।

চাকরির বাজার যে কতটা খারাপ, সেটা আজ যিনি মাস্টার্সের শেষ পরীক্ষা দিলেন তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন না । সরকারী চাকরীর কথা বাদই দিলাম। বেসরকারি চাকরি পাওয়া যে এখন কতটা কঠিন, যে এ পথে হাটছেন সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।

আমি যখন আই বি এ তে এম বি এ করছিলাম, তখন থেকেই ভাবতাম যে একটা ব্যবসা করব । কিন্তু কখনো কাউকে বলা বা কারো কাছে পরামর্শ চাইতে সাহস পাইনি। এমনকি বিজনেসে লেখাপড়া করেও বোকার মত থেকেছি আর চিন্তা করেছি, কি করব? কারন আই বি এ থেকে পাশ করা ছেলে যদি কোন কিছু বেচা বিক্রি করা শুরু করে, তাহলে নিশ্চয় বাবা মা সমাজে মুখ দেখাতে পারবেন না। তাই এ ভয়ে আমিও চুপ করেই ছিলাম ।

কিন্তু তারপর শুরু করলাম এম বি এ। শেষ করার ১ বছর পর ভয়ে ভয়ে ব্যবসা শুরু করি। আর সেটা ছিল রাজশাহীর আম বেচা। মানুষ ঢাকিতে করে রাস্তায় আম বেচে, আর আমি ফেসবুকে আম বেচি। ঘটনা কিন্তু একটাই বেচা বিক্রি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আম কেন? কারন আমাদের নিজেদের আমের বাগান আছে, আর আমি ফেসবুক মার্কেটিং একটু ভাল বুঝতাম তাই।

তার পর আর থেমে থাকতে হয়নি। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু “রাজশাহীর আম” নামক ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে আমের ব্যবসা। বাংলাদেশে আমিই প্রথম ২০১৯ সাল থেকে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে রাজশাহীর ফ্রেস এবং ফর্মালিন মুক্ত আম সরাসরি কাষ্টমারের কাছে সেল করেছি সারাদেশে। বর্তমানে আমার মোবাইল অ্যাপে রেজিস্টার কৃত ক্রেতার সংখ্যা ৬ হাজারের বেশি। কিন্তু এখন খুব আপসোস করি যদি আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকেই আমের বেচা বিক্রি নিয়ে কাজ করতাম তাহলে নিশ্চয় আজ আমার বিজনেস অনেক অনেক দূর এগিয়ে যেত।

সবাই কে যে চাকুরী করতে হবে এমন তো কোন কথা নেই । ব্যবসা করেও মানুষ অনেক ভাল করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের প্রথম দিন থেকেই কিছু একটা শুরু করে দেয়া উচিৎ। হোক সেটা ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের মাঝে কাষ্টমাইজ টি শার্ট সেল করা, কিংবা বিভিন্ন মেসের প্রতিদিনের বাজার সাপ্লাই দেয়া অথবা বুটিকের ড্রেস সংগ্রহ করে হলের মেয়েদের কাছে সেল করা। বিশ্বাস করেন মনের জোর নিয়ে প্রবল ইচ্ছা শক্তি নিয়ে আপনি যেটা শুরু করবেন সেটাই ভাল হবে। হয়তবা প্রথম ছয় মাস আপনি তেমন প্রোডাক্ট বিক্রি করতে পারলেন না, কিন্তু এ ছয়মাসে আপনি ঠিকই বুঝে গেছেন যে কেন আপনি সেল করতে পারেননি বা কেন সেল হয়নি? যে প্র্যাকটিকাল লানিং আপনি এ ছয় মাসে পাবেন, তা একজন এম বি এ কমপ্লিট করা ছাত্রও শিখে উঠতে পারেনি বই পড়ে। কিন্তু তার পরের মাস থেকে ঠিকই আপনি সেল পাচ্ছেন বা লাভের মুখ দেখা শুরু করেছেন। ধিরে ধিরে কিন্তু আপনার সেল বাড়ছে এবং লাভও বাড়ছে। সাথে আপনার লেখা পড়াও চলছে। এই ব্যবসা করার জন্য আপনার লেখা পড়ার খরচ আপনি নিজেই চালাতে পারছেন।

যখন আপনি অনার্স পাশ করেছেন তখন আপনার ব্যবসার বয়স ৪ বছর। যখন আপনি মাস্টার্স শেষ করেছেন তখন আপনার ব্যবসার বয়স ৫ বছর। আর যে ব্যবসার বয়স ৫ বছর তখন নিশ্চয় সে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে শুধু আপনি একাই কাজ করবেন না আরো অনেক মানুষকে কাজ দিতে পারবেন । লেখাপড়া শেষ করার সাথে সাথেই আপনি নিজের প্রতিষ্ঠান নিয়েই আরো এগিয়ে যাবেন। সেখানে অন্যরা আমার মত বিশেষ করে মাঝারি টাইপের ছাত্ররা চাকরির জন্য রাস্তায় রাস্তায় জুতার তলা ক্ষয় করবে নয়তবা বিডি জবসে চাকরি খুঁজে বেড়াবে।

আমি তো মনে করি এটলিষ্ট বিজনেস ফ্যাকাল্টির ডিপার্টমেন্ট গুলো এমন নিয়ম চালু করতে পারে যে প্রথম সেমিষ্টার থেকেই ক্লাসের ছাত্ররা মিলে একটা করে স্টার্টাপ চালু করবে। যেখানে প্রতিটা ছাত্র একটা করে শেয়ার কিনবে এবং সকলেই কাজ ভাগ করে এই স্টার্টাপ কে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

প্রাথমিক ভাবে ডিপার্টমেন্ট কিছু ফান্ড দেবে এবং একজন করে শিক্ষক এ স্টার্টাপের মেন্টর হিসেবে দায়িত্ব নেবেন। তাহলে একাডেমিক লেখা পড়া শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে একটা করে নতুন বিজনেস প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে যাবে। যেখানে কাজ করবে ওই ব্যাচের ছাত্ররা এবং সেই প্রতিষ্ঠানের মালিকও হবেন তারাই। এতে দেশে যেমন বেকারত্ব কমে যাবে তেমনি অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিশালী দেশ। আমি স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি স্বপ্ন নিয়ে বাঁচি । সকলের জন্য রইল শুভকামনা।

এসএইচ-১০/০৯/২২ (হাসান তানভীর, সামাজিক উদ্যোক্তা, [email protected])