দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে সোমবার সন্ধ্যাতেও সাকিব আল হাসান বারে বারে বাংলাদেশের সমর্থক ও ক্রিকেট অনুরাগীদের উদ্দেশে বলেছিলেন টুর্নামেন্টের মাঝপথেই হতাশ হওয়ার কিছু নেই – বাকি পাঁচটা ম্যাচে অনেক হিসেব ওলটপালট হতেই পারে।
কিন্তু মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে মঙ্গলবার দশেরার রাতে যেভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা কার্যত দুরমুশ করে বাংলাদেশকে হারাল, তার পর অতি বড় বাংলাদেশ সমর্থকও বোধহয় দলকে নিয়ে খুব বেশি কিছু আর আশা করতে ভয় পাবেন।
দলের জন্য বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে ওঠার লক্ষ্য পূরণও এখন কার্যত অসম্ভব – মুম্বাইয়ের ম্যাচে ‘সান্ত্বনার সেঞ্চুরি’ করা মাহমুদুল্লাহ্-ও সে কথা প্রকারান্তরে স্বীকারই করে নিলেন।
বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের স্কোয়াড নির্বাচন, অধিনায়কত্ব, তামিম ইকবালের অবসর ও ফিরে আসা ইত্যাদি নানা ইস্যুতে বিতর্ক চলছিলই – তাতে সার্বিকভাবে টুর্নামেন্টের জন্য দলের প্রস্তুতিও নিশ্চয় কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়েছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে পনেরো জনের স্কোয়াড বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে পা রাখে – তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রত্যাশা যে আরও অনেক বেশি ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিশেষত বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে বাংলাদেশ অতীতে প্রায় প্রতিবারই দু’তিনটে বড় বড় প্রতিপক্ষকে হারিয়ে চমক দিয়েছে – অথচ এবারে আফগানিস্তান ছাড়া আর কোনও ম্যাচেই তারা এখনও জেতার ধারেকাছে যেতে পারেনি।
টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের আরও চারটে ম্যাচ বাকি আছে ঠিকই (প্রতিপক্ষরা যথাক্রমে নেদারল্যান্ডস, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও অস্ট্রেলিয়া) – কিন্তু এ পর্যন্ত বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরমেন্সকে বেশ হতাশাজনকই বলতে হবে।
ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ দলের এই ব্যর্থতার যে কারণগুলো চিহ্নিত করছেন সেগুলো নিয়েই এক এক করে আলোচনা করা হল।
বাংলাদেশের টপ অর্ডার ও মিডল অর্ডারের ধারাবাহিক ব্যর্থতা যে বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে তা স্কোরবোর্ডে চোখ বোলালেই স্পষ্ট হয়ে যাবে।
পুনে-তে ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচেই শুধুমাত্র বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি ৯৩ রানের একটি পার্টনারশিপ খেলেছিল – এছাড়া বাকি চারটি ম্যাচেই দলের টপ অর্ডার বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।
পুনেতে ওপেনিং জুটি সাফল্য পেলেও মিডল ওভারগুলোতে আবার বাংলাদেশের ব্যাটিং পরপর উইকেট হারিয়ে চাপের মুখে পড়ে যায়।
বাংলাদেশের খেলা পাঁচটি ম্যাচের মধ্যে দলের হয়ে সেঞ্চুরি মাত্র একটিই – যদিও মুম্বাইতে মাহমুদুল্লাহ-র করা সেই ১১১ বলে ১১১ দলকে জেতাতে পারেনি, শুধু হারের ব্যবধান কিছুটা ভদ্রস্থ করেছে।
তানজিদ হোসেন তামিম, নাজমুল হোসেন শান্ত, তওহীদ হৃদয়ের মতো ব্যাটাররা পর পর ব্যর্থ হয়েছেন।
লিটন দাস দুটো হাফসেঞ্চুরি করলেও সেগুলোকে বড় ইনিংসে কনভার্ট করতে পারেননি – আর বাকি তিনটে ইনিংসে তো তাকে ব্যর্থই বলতে হবে।
ভারতের সাবেক ওপেনিং ব্যাটসম্যান ওয়াসিম জাফর মনে করেন, টুর্নামেন্টে যে দলগুলো ভাল করছে তাদের তুলনায় বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে কম করে সত্তর-আশি রানের একটা ‘শর্টফল’ বা ঘাটতি হয়ে যাচ্ছে।
“ওয়ানডে ক্রিকেটে যেখানে এখন তিনশো-সাড়ে তিনশো করেও জেতা নিশ্চিত নয়, সেখানে বাংলাদেশ সোয়া দুশো বা আড়াইশোর মধ্যেই আটকে থাকছে”, পুনেতে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন জাফর।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে হারের পর মাহমুদুল্লাহ সেই পরাজয়ের একটা বেশ নিস্পৃহ অথচ আকর্ষণীয় ব্যাখ্যা দিলেন।
তিনি বলছিলেন, “আসলে আমরা সঠিক সময়ে অপরচুনিটি বা সুযোগগুলো তৈরি করতে পারিনি। এই ধরনের ম্যাচে জিততে হলে যেটা ভীষণ দরকার।
“আফগানিস্তান ম্যাচটায় আমরা জিতেছিলাম কারণ আমাদের বোলাররা দারুন বল করে সে দিন খুব ভাল অপরচুনিটি তৈরি করতে পেরেছিল এবং টিম সেটা খুব ভালভাবে কাজে লাগাতে পেরেছিল।“
দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রেও প্রথম দুই উইকেট বেশ কম রানে ফেলে দেওয়ার পর বোলাররা যদি আরও দু’তিনটে অপরচুনিটি তৈরি করতে পারত তাহলে খেলার মোড় ঘুরে যেতেই পারত – এমনই ইঙ্গিত পাওয়া গেল তার গলায়।
“গেমপ্ল্যান আমাদের ঠিকই আছে, সেগুলো নিয়ে চর্চাও হচ্ছে। কিন্তু মাঠে নেমে সেটা এক্সিকিউশন করতে পারছি না আমরা ঠিকমতো”, খোলাখুলি স্বীকারও করে নিলেন মাহমুদুল্লাহ।
বাংলাদেশ বোলিংয়ের বড় ভরসা তাদের স্পিনাররা – কিন্তু আফগানিস্তান ম্যাচটা বাদ দিলে সাকিব আল হাসান কিংবা মেহেদি হাসান মিরাজরা কিন্তু এই উপমহাদেশের উইকেটেও সেভাবে দাগ কাটতে পারেননি এবং দলের সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় ‘ব্রেকথ্রু’ এনে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বাংলাদেশ দল এই ‘সুযোগ’গুলো ঠিকমতো তৈরি করতে পারছে না বলেই কোনও দিন ডাউইড মালান বা ড্যারিল মিচেল, কিংবা কোনও দিন ভিরাট কোহলি বা কুইন্টন ডি কক তার ফায়দা তুলে নিয়ে যাচ্ছেন পুরোদস্তুর!
বিশ্বকাপে বাংলাদেশ টিম নিয়ে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেছেন ভারতের সাবেক ক্রিকেট তারকা ও বর্তমানে ক্রিকেট ভাষ্যকার সঞ্জয় মঞ্জরেকর।
মঞ্জরেকর বলছেন, “এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশই হল একমাত্র দল যাতে দু’জন ক্রিকেটার তাদের পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলছেন – সাকিব আল হাসান আর মুশফিকুর রহিম।“
সঙ্গে রয়েছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদও, যার এটি কেরিয়ারের চতুর্থ বিশ্বকাপ।
এই তিনজন সিনিয়রই কিন্তু আজও বাংলাদেশ টিমের ‘নিউক্লিয়াস’ – মূলত তাদের পারফরমেন্সের ওপর ভিত্তি করেই দলটা এখনও এগোচ্ছে এবং দরকারের সময় তাদের ওপরই সবচেয়ে বেশি ভরসা করছে।
মঞ্জরেকরের বক্তব্য হল, “অন্য দলগুলোতেও সিনিয়ররা আছেন, কিন্তু তাদের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের ক্রিকেটাররাও দায়িত্ব ভাগ করে নিচ্ছেন! এই জায়গাটায় বাংলাদেশের কিন্তু বিরাট একটা খামতি দেখা যাচ্ছে।”
সোজা কথায় দক্ষিণ আফ্রিকা টিমে যেমন হাইনরিক ক্লাসেনের মতো তরুণরা ডি ককের মতো সিনিয়রদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খেলছেন – কিংবা ভারতীয় দলে শুভমান গিল-শ্রেয়স আইয়াররা কোহলি-রোহিত শর্মাদের ওপর থেকে চাপ অনেকটা সরিয়ে নিতে পারছেন – বাংলাদেশ দলে সেরকম কিছু এখনও দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্বকাপের মতো বড় টুর্নামেন্টে এখনও সাকিব-মুশফিক-রিয়াদের মতো সিনিয়রদের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতাই বাংলাদেশকে এতটা ভোগাচ্ছে বলে মঞ্জরেকরের ধারণা।
বিশ্বকাপের আগের কয়েক মাসে এবং তারপর এই টুর্নামেন্টেও ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে বাংলাদেশ যত রকমের ‘এক্সপেরিমেন্ট’ করেছে, সেটা বোধহয় অন্য আর কোনও টিম করেনি।
মেহেদি হাসান মিরাজের যেমন ওপেনিং থেকে সাত নম্বর – মোটামুটি সবগুলো পোজিশনেই খেলা হয়ে গেছে।
নাজমুল হোসেন শান্ত ওপেনিং থেকে নেমে এসেছেন তিন নম্বরে – অন্য দিকে তওহীদ হৃদয় পাঁচ নম্বর থেকে নেমে গেছেন সাত নম্বরে। দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে অবশ্য হৃদয়কে খেলানোই হয়নি।
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ যখন প্রথম এগারোতে সুযোগ পেয়েছেন, খেলেছেন আট ও ছয় নম্বরে। এবং এমন উদাহরণ আরও অজস্র।
মঙ্গলবার রাতে ভারতের সুপরিচিত ক্রিকেট ভাষ্যকার হর্ষা ভোগলে তো বলেই ফেললেন, “বাংলাদেশ কি এখনও বুঝতে পেরেছে তাদের সেরা ব্যাটিং অর্ডার কোনটা? না কি তারা এখনও পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েই যাবে?”
ভোগলের মতে, পাঁচ আর ছয় নম্বরে যথাক্রমে মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদুল্লাহ – আর চারে সাকিব – এটাই হওয়া উচিত বাংলাদেশের স্বাভাবিক চয়েস।
ভাইস ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন শান্ত অবশ্য বিশ্বকাপ চলাকালীন একাধিকবার দাবি করেছেন, দলের সব ব্যাটারকেই আগেভাগে জানিয়ে দেওয়া হয় তাদের সে দিন কত নম্বরে নামতে হবে।
“এটা নিয়ে কিন্তু দলের কারওরই কোনও অভিযোগ নাই। আর দলের প্রয়োজনে সবাই যেখানে দরকার সেখানেই নামতে রাজি”, এ কথাও জানিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু ব্যাটিং অর্ডারে খেয়ালখুশিমতো ওলটপালট বাংলাদেশ দলের যে কোনও কাজে আসেনি, বিশ্বকাপে তাদের পাঁচটা ম্যাচের পর সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে মুম্বাইতে বাংলাদেশ প্রায় শ’দেড়েক রানে হারলেও মাহমুদুল্লাহ-র সেঞ্চুরি দলের মোট সংগ্রহ ও নেট রানরেট-কে কিছুটা হলেও ভদ্রস্থ করেছে।
ক্রিকেট বিশ্বকাপে এটা তার তৃতীয় শতরান – এবং সেটাও এসেছে ১০০ স্ট্রাইক রেটে।
অথচ স্কোয়াডে তার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। এশিয়া কাপ থেকে বাদ পড়েছিলেন, বিশ্বকাপ দলে আদৌ ঢুকতে পারবেন কি না তা নিয়েও ছিল ঘোর অনিশ্চয়তা।
সেগুলো নিয়ে মাহমুদুল্লার চাপা অভিমান নিশ্চয় আছে, সেটার ইঙ্গিত পাওয়া গেল ম্যাচের পর তার সাংবাদিক সম্মেলনেও। যদিও বললেন এসব নিয়ে পরে কথা বলা যাবে – এখন ওসবের সময় নয়।
কিন্তু বাংলাদেশ টিম যে মাহমুদুল্লার মতো একজন ক্রিকেটারকে বিশ্বকাপে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনি, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই ভারতের ক্রিকেট বিশ্লেষক জয় ভট্টাচার্যের।
‘ক্রিকবাজ’ সাইটকে মি ভট্টাচার্য বলেছেন, “আপনি যদি মাহমুদুল্লাহ-কে স্কোয়াডে না রাখতেন, তাহলে অন্য কথা। কিন্তু তাকে দলে পিক করার পর যেভাবে কাজে লাগাচ্ছেন – সেটার মধ্যে কোনও মাথামুন্ডু নেই!”
মাহমুদুল্লাহ ধরমশালার প্রথম ম্যাচে এগারোতেই জায়গা পাননি। এরপর যখন সুযোগ পেয়েছেন, তাকে ব্যাট করতে নামানো হয়েছে আট নম্বরে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ছ’নম্বরে নেমে তিনি আবার শতরান করেছেন।
“মাহমুদুল্লাহ-র অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে যে বাংলাদেশ টিম সফলভাবে কাজে লাগাতে পারেনি তাতে কোনও সন্দেহ নেই”, বলছেন জয় ভট্টাচার্য।
মঙ্গলবার রাতে ওয়াংখেড়েতে মাহমুদুল্লাহ-র পারফরমেন্সের পর বাংলাদেশের বহু ক্রিকেট সমর্থকই নিশ্চয় এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত হবেন।
এসএইচ-০৩/২৫/২৩ (স্পোর্টস ডেস্ক)