আফগানদের সেমিফাইনালের দৌড়ে টিকে থাকতে শহীদি অনন্য

বিশ্ব ক্রিকেটে আফগানিস্তানের রূপকথার মতো উত্থানের গল্পটা তো সবার জানা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হয়েও এত অল্প সময়ে ক্রিকেটে দ্রুততম উন্নতিতে ‘রোল মডেল’ হয়ে আছে আফগানরা।

দলটি এবারের বিশ্বকাপেও একের পর এক চমক দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের পর পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে সেমিফাইনালের দৌড়ে ভালোভাবেই টিকে আছে।

আফগানদের এই সাফল্যে রশিদ খান–মুজিব উর রেহমানদের মতো তারকাদের নামই সামনে আসে। কিন্তু দলটাকে একসূত্রে গেঁথে যিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই হাশমতউল্লাহ শহীদি যেন বরাবরই খানিকটা আড়াল।

শহীদির অধিনায়কত্বেই আফগানিস্তান সাবেক তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে দিয়েছে। ২৮ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান নিজেও আছেন দারুণ ছন্দে। সর্বশেষ দুই ম্যাচে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছেড়েছেন, সর্বশেষ আট ওয়ানডের চারটিতেই করেছেন অর্ধশত, একটি আবার ৪৮ রানে অপরাজিত।

আফগান ক্রিকেটে এই যে মানসিকতার পরিবর্তন, ক্রিকেটের প্রতি তাঁর আবেগ, ক্রিকেটের মাধ্যমে দেশবাসীর মুখে হাসি ফোটানো, ব্যক্তিগত জীবন, পছন্দ–অপছন্দসহ নানা বিষয় নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন শহীদি। সেই সাক্ষাৎকারেই জানিয়েছেন, পদার্থবিজ্ঞানের বই রেখে হাতে ব্যাট তুলে নিয়ে এসেছেন আজকের অবস্থানে।

শহীদির জন্ম আফগানিস্তানের লোগার প্রদেশে; দেশটির রাজধানী কাবুল থেকে লোগারের দূরত্ব ৮৭ কিলোমিটার। তাঁর বাবা মোহাম্মদ হাশিম শহীদি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক, যিনি বিজ্ঞান নিয়ে ৪৪টি বই লিখেছেন।

হাশিম শহীদি চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে হাশমতউল্লাহ শহীদি বড় মাপের বিজ্ঞানী হোক। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে ছেলের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। সারাদিন কাটত কুমার সাঙ্গাকারার ব্যাটিং আর বলিউড সিনেমা নিয়ে।

বেড়ে ওঠার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সাক্ষাৎকারে শহীদি বলেছেন, ‘আমি শিক্ষিত পরিবারে জন্মেছি। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানের সব পাঠ্যপুস্তক আমার বাবা লিখেছেন। বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা ৪৪টি। খুব স্মার্ট ছিলেন। চেয়েছিলেন আমি যেন পড়াশোনাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই আর ক্রিকেট শখের বশে খেলি। কিন্তু আমি পড়াশোনায় কখনোই ভালো ছিলাম না। পদার্থবিজ্ঞান নিয়েও কোনো আগ্রহ ছিল না।’

বাবাকে খুশি করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাও দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন আফগান অধিনায়ক, ‘বাবা চেয়েছিলেন আমার পূর্ণ মনোযোগ যেন শুধু লেখাপড়াতেই থাকে। আমিও বলেছিলাম ঠিক আছে। তাঁকে খুশি রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাতেও বসেছিলাম। কিন্তু আমার নেশা ছিল ক্রিকেট। যখন আমি অনূর্ধ্ব–১৯ দলে জায়গা করে নিলাম, সবে স্কুলজীবন শেষ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।’

২০১৮ সালে হাশমতউল্লাহ শহীদির বাবা হাশিম শহীদি মারা যান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার ছেলের খেলা দেখে যেতে পারেননি বাবা—এটাই শহীদির জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ, ‘মনে আছে, দিনের খেলা শেষে আমি ১২০ রানে অপরাজিত ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি বাবাকে ফোন করলাম। বললাম, আমার জন্য দোয়া করতে যাতে (পরের দিন) দ্বিশতক পূরণ করতে পারি। সেদিন আমাদের বাড়িতে কজন মেহমান এসেছিলেন। বাবা ফোন ধরেই বললেন, “আমি ব্যস্ত আছি। কাল দ্বিশতক পূরণ করো। তারপর কথা হবে।” এরপরেই বাবা ফোন কেটে দিলেন। তাঁর সঙ্গে ওটাই ছিল শেষ কথা। এরপর বাবা ঘুমিয়ে পড়লেন। আর কখনো জাগেননি! আমি তখন বাড়ি থেকে ছয় ঘণ্টার দূরত্বে ছিলাম।’

বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে খেলা বাদ দিয়ে বাড়ি ছুটে গিয়েছিলেন শহীদি। তাই দ্বিশতক পাওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত দ্বিশতকটা পেলেন তিন বছর পর, ২০২১ সালের মার্চে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আবুধাবি টেস্টে। এটাই এখন পর্যন্ত টেস্টে কোনো আফগান ব্যাটসম্যানের প্রথম ও একমাত্র দ্বিশতক।

অপরাজিত ২০০ রানের ইনিংস উপহার দেওয়ার দুই মাস পরেই শহীদিকে আফগানিস্তানের টেস্ট ও ওয়ানডে দলের অধিনায়ক বানানো হয়। কিন্তু এর তিন মাস পরেই শহীদির জীবনে আরেকটি ধাক্কা হয়ে আসে তাঁর মায়ের মৃত্যু।

মা হারানোর বেদনা ভুলে এত বড় দায়িত্বে মনোযোগী হওয়া শুরুতে শহীদির জন্য কঠিন ছিল, ‘যখন আমি নেতৃত্ব পেলাম, দায়িত্ব সামলানো সহজ ছিল না। তবে বোর্ড যেহেতু চেয়েছে, আমি এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছি। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল স্বার্থপর না হওয়া, শুধু দেশের জন্য খেলা। আল্লাহর রহমতে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে।’

বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত ৬ ইনিংসে ২২৬ রান করেছেন হাশমতউল্লাহ শহীদি। টুর্নামেন্টে তিনিই আফগানদের মধ্যে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক। লক্ষ্ণৌয়ে আগামীকাল শুক্রবার নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও নিশ্চয় বড় অবদান রাখতে চাইবেন। কাল জিতলে সেমির দৌড়ে আরও ভালোভাবে টিকে থাকবে আফগানিস্তান।

শহীদিও নিশ্চয় তৃপ্তি নিয়ে কেক কাটতে পারবেন। শনিবার যে তাঁর ২৯তম জন্মদিন!

এসএইচ-০৪/০২/২৩ (স্পো্টস ডেস্ক)