বিশ্বকাপের আসল বিস্ময় ও সেমিফাইনালের সমীকরণ

ভারত রীতিমতো উড়ছে। একই কথা দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কেও বলা যেত, যদি আগে-পরে উড়তে উড়তে মাঝখানে কমলা-দেয়ালে ধাক্কা না খেত। কমলা দেয়াল মানে নেদারল্যান্ডস। এই বিশ্বকাপে আইসিসির সহযোগী সদস্য একমাত্র দেশ। তাদের যেকোনো জয়ই তাই অঘটন হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কথা। তবে এই বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার যে পারফরম্যান্স, তাতে নেদারল্যান্ডসের তাদের হারিয়ে দেওয়াটাকে মনে হচ্ছে ‘অঘটনের বাবা’।

ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচটাকে ফাইনালের আগে ফাইনাল মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তবে সেই অর্থে কি এটির খুব একটা গুরুত্ব আছে! দুই দলেরই সেমিফাইনাল নিশ্চিত। কলকাতার ইডেনে গার্ডেনে ম্যাচটাকে বলতে পারেন রাউন্ড রবিন লিগের শীর্ষস্থান নির্ধারণী। এই ম্যাচে জয়ী দলই হয়তো এক নম্বর হিসেবে সেমিফাইনালে খেলবে। তা বিশ্বকাপে এক নম্বর আর চার নম্বর হয়ে সেমিফাইনাল খেলায় এমন কীই-বা আসে যায়!

ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকা তো উঠেই গেছে। একটু ঝুঁকি নিয়ে বলে ফেলা যায়, অস্ট্রেলিয়াও। প্রথম দুই ম্যাচে ছন্নছাড়া অস্ট্রেলিয়া টানা পাঁচ ম্যাচে দেখা দিয়েছে পরিচিত রূপে। মানে বিশ্বকাপের অস্ট্রেলিয়া যেমন হয় আর কি! ডেভিড ওয়ার্নার তো আর এমনি বলেননি, ‘আমরা এই বিশ্বকাপগুলোর জন্যই বেঁচে থাকি।’

অস্ট্রেলিয়ার অস্ট্রেলিয়া–রূপে দেখা দেওয়া কোনো বিস্ময় নয়। এই বিশ্বকাপে বিস্ময় যদি কিছু থেকে থাকে, সেই তালিকার এক-দুই-তিন নম্বর সব কটিতেই থাকা উচিত ইংল্যান্ডের নাম। শিরোপা ধরে রাখার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বকাপে এসে কোনো দলের এমন করুণ অবস্থা এর আগে হয়নি। বাংলাদেশ কেন এত খারাপ করেছে, তার অনেক কারণই চাইলে খুঁজে নেওয়া যায়। সাদা বলে ব্যাটিংয়ের ব্যাকরণ বদলে দেওয়া ইংল্যান্ডের হঠাৎ করেই খেলা ভুলে যাওয়াটা যেখানে রীতিমতো এক রহস্য।

ইউটিউবে এবি ডি ভিলিয়ার্সের সঙ্গে মাইকেল আথারটনের একটা ভিডিও দেখলাম সেদিন। ডি ভিলিয়ার্স ইংল্যান্ডের এই করুণ অবস্থার কারণ জানতে চাওয়ায় আথারটন এটা-ওটা বলে কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেই বুঝতে পারলেন, এসবে আসলে ঠিক ব্যাখ্যা মিলছে না। বাধ্য হয়ে তাই তাঁকে বলতে হলো, খেলাধুলায় কখনো কখনো এমন কিছু ঘটে, যা আসলে ব্যাখ্যা করা যায় না।

পাকিস্তানকে বোধ হয় ব্যাখ্যা করা যায়। প্রথম দুই ম্যাচে দাপুটে জয়ের পর টানা চার ম্যাচে পরাজয়। এরপর আবার টানা দুই জয়ে সেমিফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে ফিরে আসা—পাকিস্তান তো এমনই।

নিউজিল্যান্ড ৪০১ রান করে ফেলার পর ব্যাটিংয়ে নেমে ‘এই রানও কেন তাড়া করা যাবে না’ বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটা খুব বেশি দল করতে পারত বলে মনে হয় না। এত রান করেও ডাকওয়ার্থ-লুইসে হারলে নির্ঘাত সেই দলকে দুর্ভাগা মনে হওয়ার কথা। অথচ কেন উইলিয়ামসনও এই পরাজয়ের জন্য বৃষ্টিকে দুষতে পারছেন না। ফখর জামানের ব্যাটে চড়ে পাকিস্তান যেভাবে জবাব দিচ্ছিল, তাতে পুরো ম্যাচ হলেও হয়তো তারাই জিতত। এই বিশ্বকাপেই দ্বিতীয়বার ভেঙে দিত সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড।

সব আশা শেষ হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানের এভাবে ফিরে আসা মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৯৯২ বিশ্বকাপ। যে বিশ্বকাপ পাকিস্তানের জন্য অন্তহীন এক প্রেরণার নাম। বিশ্বকাপ জয় ওই একবারই, এটা অবশ্যই একটা কারণ। তবে আসল কারণ নয়। আসল কারণ যেভাবে তা জিতেছিল। খাদের কিনারা থেকে উঠে এসে মেলবোর্নে ইমরান খানের ট্রফি উঁচিয়ে ধরার মতো অবিশ্বাস্য গল্প বিশ্বকাপে এর আগে-পরে আর লেখা হয়নি। যেটির কথা উঠলেই পাকিস্তানের ওই দলের ওপেনার রমিজ রাজা বলেন, ‘অনেক মানুষ আমাদের জন্য প্রার্থনা করেছিল। নইলে এটা হওয়ার কথা নয়।‘

এরপর প্রতিটি বিশ্বকাপেই পাকিস্তানের সব অধিনায়ক কোনো না কোনো সময়ে ১৯৯২-এ আশ্রয় নিয়েছেন। দলকে হয়তো মনে করিয়েও দিয়েছেন ইমরান খানের বিখ্যাত ওই ‘কর্নারড্ টাইগার’ গল্প। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জীবন-মরণ ম্যাচ।

ইমরান খান টস করতে নামলেন বুকে বাঘের ছবি আঁকা একটা টি শার্ট পরে। ধারাভাষ্যকার ইয়ান চ্যাপেল জানতে চাইলেন, ঘটনা কী। ইমরান বললেন, তিনি চান তাঁর দল কোণঠাসা বাঘের মতো লড়াই করুক। বাঘ কোণঠাসা হয়ে গেলেই তো সবচেয়ে ভয়ংকর। এখন আর চাইলেও কোনো অধিনায়ক এমন করতে পারবেন না। আইসিসির নিয়মে আটকে যাবেন। যদিও সুযোগ থাকলেও বাবর আজম কখনো এমন করতেন বলে মনে হয় না। তাঁর নেতৃত্বের ধরনটাই আলাদা। ইমরান বলে ভুল করার কোনো অবকাশই নেই।

নিউজিল্যান্ড ম্যাচে বৃষ্টিটাকে অবশ্য বাবর কাজে লাগাতেই পারেন। ফখর জামানের ব্যাট যতই ধারালো তরবারি হয়ে উঠুক না কেন, পুরো ম্যাচ হলে পাকিস্তানের পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা তো ছিলই। ৪০২ অনেক দূরের পথ, দুস্তরও বটে। বৃষ্টি হয়তো তাই পাকিস্তানের জন্য আশীর্বাদ হয়েই এসেছে। যেমন এসেছিল ১৯৯২ বিশ্বকাপে। এবার যেমন হয়তো-টয়তো বলতে হচ্ছে, সেবার তা ব্যবহারের সুযোগ ছিল না।

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৭৪ রানে অলআউট হয়ে গিয়েও বৃষ্টির কল্যাণেই ১ পয়েন্ট পেয়েছিল পাকিস্তান। সেই ১ পয়েন্ট-ই পরে তাদেরকে সেমিফাইনালে তুলে দেয়। তবে সেটিও অবিশ্বাস্য এক নাটকীয়তার পর। নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পর পুরো পাকিস্তান দল টিভির সামনে বসে ছিল। একই দিন অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচ হচ্ছে। যেটিতে জিতলে ওয়েস্ট ইন্ডিজই উঠে যাবে সেমিফাইনালে। হট ফেবারিট হিসেবে সেই বিশ্বকাপ শুরু করা স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার সেই ম্যাচ জিতে অর্থহীন ২ পয়েন্টের বেশি কিছু পাওয়ার ছিল না। তারপরও তারা জেতে। পাকিস্তান উঠে যায় সেমিফাইনালে। বাকিটুকু ইতিহাস।

এবারও এমন বলতে হলে আগে তো পাকিস্তানকে সেমিফাইনালে উঠতে হবে। সেই হিসাবটা কী? প্রথম চার ম্যাচ জিতে পরের চার ম্যাচ হারা নিউজিল্যান্ডের পয়েন্টও পাকিস্তানের সমান। এক ম্যাচ কমে খেলে এই দুই দলের সমান ৮ পয়েন্ট আফগানিস্তানেরও। নিউজিল্যান্ড আর পাকিস্তানের একটা করে ম্যাচই বাকি। প্রতিপক্ষ যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা ও ইংল্যান্ড।

এই বিশ্বকাপের ফর্ম অনুযায়ী দুই দলেরই জেতা উচিত। সেই উচিত কাজটাই যদি হয়, তাহলে সেমিফাইনালিস্ট নির্ধারক হয়ে উঠবে নেট রান রেট। নিউজিল্যান্ড যেটিতে এখন সামান্য এগিয়ে। পাকিস্তানের ম্যাচটা পরে, এটা একটা সুবিধা। নেট রান রেটের হিসাব-নিকাশটা পরিষ্কার জেনেই ১১ নভেম্বর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নামতে পারবে। এর আগে নিউজিল্যান্ড শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে গেলে তো হিসাবটা আরও সহজ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে জিতলেই সেমিফাইনাল।

সেমিফাইনালের শেষ জায়গাটার জন্য লড়াইকে ত্রিমুখী বানিয়ে আফগানিস্তানের কথা বলেও বাকি দুই দলের হিসাব-নিকাশে চলে যাওয়ার কারণ আছে। কাগজে-কলমে তাদের চেয়ে বড় তিন দলকে হারিয়েছে আফগানিস্তান। তারপরও শেষ দুই ম্যাচে তাদের জয় পাওয়াটাকে একটু কষ্টকল্পনাই মনে হচ্ছে। সেই দুটি ম্যাচে প্রতিপক্ষের নাম যে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। আফগানিস্তান কীভাবে জেতে! কীভাবে জেতে? ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যেভাবে জিতেছে। ওই ম্যাচগুলোর আগেও কি আফগানিস্তানের জয়ের কথা ভেবেছিলেন কেউ!

এসএইচ-১০/০৫/২৩ (স্পোর্টস ডেস্ক)