যেন এক ইনিংসেই দুই ম্যাচ দেখা হয়ে গেল! দুই মেরুর ব্যবধান দুই ম্যাচে! আহমেদাবাদে রোববার বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারত ২৪১ রানের লক্ষ্য দিয়েছে অস্ট্রেলিয়াকে। পিচের অবস্থা যেমন এবড়োখেবড়ো মনে হচ্ছে, তাতে ভারতের এই রানকেও ‘মাত্র’ বলা যাচ্ছে না। এই পিচে কুলদীপ, জাদেজাদের সামলাতে বেগ পেতে হওয়ার কথা অস্ট্রেলিয়াকে। শামি, বুমরাহর বলও কিছুটা নিচু হয়ে আসতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসটা কীভাবে এগোয়, সেটি তাই আগ্রহ জাগাচ্ছে।
তবে এর আগে ভারতের ইনিংসে যা হলো, সেটিই-বা কী কম আকর্ষণজাগানিয়া! মোটা দাগে দুই ইনিংসে ভাগ করে নেওয়া যায় ইনিংসটাকে – প্রথম দশ ওভার, পরের চল্লিশ ওভার। প্রথম ১০ ওভারে ভারত যদি ঘুড়ির মতো উড়ে থাকে, পরের ৪০ ওভারে তাদের গোত্তা খেতে বাধ্য করেছে অস্ট্রেলিয়া। কীভাবে সেটা করলেন মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্সরা?
পিচ যখন নতুন ছিল, তখনো রোহিত শর্মার ঝড়ে ভারত প্রথম ১০ ওভারে তুলেছে ২ উইকেটে ৮০ রান। সে সময়ে বাউন্ডারি এসেছে ১২টি। রোহিতই ৪টা চার আর ৩ ছক্কা মেরেছেন। কিন্তু পরের ৪০ ওভারে ভারত মারতে পেরেছে মাত্র ৪টি চার। মাঝে তো ৯৭ বলে কোনো বাউন্ডারিই পায়নি!
ধীরগতির এমন পিচে যেমন বোলিং দরকার, অস্ট্রেলিয়া তা-ই করেছে। নিয়ন্ত্রণ, লাইন-লেংথ…দুর্দান্ত! পাঁচটা ক্যাচ গেছে উইকেটকিপারের হাতে, একজন হয়েছেন বোল্ড, একজন এলবিডাব্লিউ – এটাই বলে, অস্ট্রেলিয়ার বোলিং কতটা দুর্দান্ত হয়েছে।
রোহিত শর্মাকে শেষ পর্যন্ত রুখে দেওয়ার আগে নতুন পিচে তিনি ঝড় ঠিকই তুলেছেন। রোহিতকে ফেরাতে অবিশ্বাস্য এক ক্যাচই লেগেছে, ট্রাভিস হেডের ক্যাচটি বারবার দেখতে মন চাইবে। রোহিতের ঝড়ের বাইরে পিচ যত পুরোনো হয়েছে, ব্যাটিং যত কঠিন হয়েছে, ততই এই পিচে ভারতের শুধু অমন দুজন ব্যাটসম্যানই রান পেয়েছেন, যাঁরা সফট হ্যান্ডে খেলতে পারেন – কোহলি ও রাহুল।
কোহলির ব্যাটে ভারত গুছিয়ে নিচ্ছিল বলে মনে হচ্ছিল। ফিফটি তুলে নিয়েছেন কোহলি। রাহুলও সে পথেই হেঁটেছেন। কিন্তু প্যাট কামিন্স এসে ভারতের গুছিয়ে নেওয়ার আশায় দিলেন ধাক্কা। তাঁর বলে প্লেইড অন হয়ে গেলেন কোহলি। শেষ পর্যন্ত এই বিশ্বকাপে পুরো দশ ওভার করেও কোনো বাউন্ডারি না দেওয়া প্রথম পেসার বনে গেছেন কামিন্স। অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক গতির ঝড় ওয়ানডে-টি-টোয়েন্টিতে সেভাবে তোলেন না, তবে তাঁর অফ কাটার কতটা দুর্বোধ্য তা আজ আবার বোঝা গেল। সূর্যকুমারকেই জিজ্ঞেস করুন!
ভারতের সংবাদমাধ্যমে আহ্লাদ করে যাঁকে এবি ডি ভিলিয়ার্সের মতো ‘৩৬০ ডিগ্রি ব্যাটসম্যান’ ডাকা হয়, সেই সূর্যকুমারের বড় দুর্বলতা – বল গতি হারালে তাঁর ব্যাট ছন্দ হারায়। অর্থাৎ, স্লো বল খেলতে পারেন না সেভাবে। অস্ট্রেলিয়া ঠিক তা-ই করেছে। সূর্যকুমার যখন ভারতের শেষ ভরসা হয়ে ক্রিজে, কামিন্স একের পর এক স্লোয়ার দিয়ে গেছেন। তাঁর স্লোয়ারে এতটাই বিভ্রান্ত সূর্যকুমার যে, এত আগেই ব্যাট চালালেন যে, তিনি ব্যাট চালিয়ে পুরো ব্যাট ‘ক্যারি’ করলেন, এরপর বল গিয়ে লাগল তাঁর গ্লাভসে – হলো উইকেটের পেছনে ক্যাচ।
কোহলি আর সূর্যকুমারকে কামিন্স ফেরানোর মাঝে মিচেল স্টার্ক দেখালেন তাঁর রিভার্স সুইংয়ের ঝলক। রাউন্ড দ্য উইকেটে চোখধাঁধানো দুই রিভার্স সুইঙ্গিং ডেলিভারিতে নিয়েছেন দুই উইকেট, যার প্রথমটি রাহুলের। সেমিফাইনাল ও ফাইনালে ছয় উইকেট নিলেন স্টার্ক, মাত্র ১৪ গড়ে।
অ্যাডাম জাম্পা পিচ স্লো দেখে নিজের বলের গতি আরও কমিয়ে দিলেন, বুমরাকে এলবিডাব্লিউ করার পথে তো বলটা করলেন ৮৪ কিলোমিটার গতিতে! ১০ ওভারে মাত্র একটা বাউন্ডারি দিয়েছেন।
এ তো গেল বোলিং, ফিল্ডিংয়েও কী দারুণ ঝলক দেখাল অস্ট্রেলিয়া! বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম দুই ম্যাচে হারের পথে একের পর এক ক্যাচ মিসে অবিশ্বাস জাগিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, সে অবিশ্বাসে মিশে ছিল হতাশা – এ কোন অস্ট্রেলিয়া। আজ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিংও অবিশ্বাস জাগাল, তবে এ অবিশ্বাসে মাখা মুগ্ধতা – এটাই তো অস্ট্রেলিয়া! রোহিতকে ফেরানোর পথে হেডের ক্যাচ তো মুগ্ধতা ছড়িয়েছেই, গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ে ওয়ার্নার-হেড-কামিন্স-জাম্পারা বাউন্ডারি বাঁচিয়েছেন একের পর এক। অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিং সাজানোও মুগ্ধ করেছে। রোহিতের জন্য তারা অফসাইডে সুইপার রেখেছে, কারণ তারা জানত রোহিত লেগ সাইডে জায়গা বানিয়ে তাদের মারার চেষ্টা করবে। সূর্যকুমার যাদবের জন্য ডিপ থার্ড ম্যানকে স্টাম্পের পেছনে অনেক সূক্ষ্ম কোণে রেখেছে, কারণ সূর্যকুমারের ‘ভি’ চ্যানেল উইকেটের সামনে নয়, পেছনে!
এসএইচ-০৯/১৯/২৩ (স্পোর্টস ডেস্ক)