পরীমনি’র বিরুদ্ধে সবাইকে এতো ঐক্যবদ্ধ কেন?

বিরুদ্ধে

জি. এম. মুরতুজা: চিত্রনায়িকা পরীমনি’র বিরুদ্ধে যেভাবে সবাই একাট্টা হয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে এমন করে একযোগে সবাই মিলে কারো বিরুদ্ধে আক্রমন ও বিরুদ্ধাচারন করতে দেখা যায় নাই। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী, সরকার, আইনশৃংঙ্খলা বাহিনী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, সাংবাদিক, লেখক এমন কি চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি জগতের মানুষ—সবাই তার বিরুদ্ধে একাট্টা। মারাত্মক অপরাধীর পক্ষেও অন্তত কিছু লোক থাকে। কিন্তু পরীমনি’র হয়ে হাতেগোনা কিছু মানুষ পক্ষ নিয়েছেন। যারা পক্ষ নিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবপক্ষ তাদের তুলোধুনো করে ছাড়ছেন, তাদের গুষ্টি উদ্ধার করছেন। পরীমনির ইস্যুতে দেশের নারীবাদী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও প্রচন্ডভাবে নীরব। অনেক তরুন-তরুনীদেরও কাজ করতে দেখি অনলাইনে নারী নির্যাতন ইস্যুতে। তারাও নীরব। একটা মেয়েকে স্পষ্টতই সেক্সুয়ালি টার্গেট করা হচ্ছে, মিডিয়া ট্রাইল করে তার চরিত্রহরন করা হচ্ছে, তাকে মারাত্মক অপরাধী প্রমানের চেষ্টা চালানো হচ্ছে- এটাতে নারী অধিকার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আগবাড়িয়ে কাজ করার কথা, প্রতিবাদের ঝড় তোলার কথা। নারীর বিরুদ্ধে এমন অসাদাচারণ করার পরও যদি তারা আওয়াজ না তুলে তাহলে আওয়াজটা তুলবে কোথায়? আর চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি তো পরীমনি’র বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমান হওয়ার আগেই তার সদস্যপদ স্থগিত করে তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

কোনো ইস্যু এতদিন মূলধারার গণমাধ্যম, অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বাসে-ট্রেনে, হাটে-বাজারে, বিমানবন্দর-জাহাজঘাটে “টক অব দ্য টপিক” বা টেন্ড্রে থাকার ঘটনাও বিরল। এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের সাথে দূর্দান্ত সিরিজ জয় এবং শেষ ম্যাচের অবিশ্বাস্য জয়, ফুটবলের বরপুত্র মেসির বেদনাদায়ক দলবদল, অলিম্পিকের মত এতবড় ক্রীড়া ইভেন্ট, করোনা ভ্যাকসিনের সংকটের মত বড় ঘটনাও পরীমনির ইস্যুকে ট্রেন্ডহীন করতে পারেনি বা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরাতে পারেনি। সবাই পরীমনি ইস্যু নিয়ে মেতে আছে। পরীমনিকে নিয়ে কেন এত মাতামাতি ও হৈচৈ করছেন?

অথচ পরীমনির বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত যেসব অপরাধ দেখানো হয়েছে, সেগুলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এতই নগন্য ও মামুলি যে, এ নিয়ে এক দুইদিনের বেশি আলোচনা হওয়ারই কথা না। বিদেশী মদের বোতল তো ঢাকার প্রায় প্রত্যেকটা বাড়ীতেই আছে, হয় মদ ভরা অবস্থায় না হয় পানি ভরা অবস্থায়। প্রায় প্রতিটি অভিজাত ও সেলিব্রেটির বাড়ী তো ছোট বড় বারে ভরা। ডিজে পার্টি ও ড্যান্স পার্টির নামে জমজমাট আসরও বসে নিয়মিত। ঢাকায় ১০ কোটি টাকার বাড়ীতে থাকেন এবং ৫/১০ কোটি চাকার গাড়িতে চড়েন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আর আমাদের অতিথ ও বর্তমানের এমন অনেক অভিনেত্রী, মডেল ও সংস্কৃতি জগতের তারকা আছেন, যারা কতবার কত মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়া ও ভাঙ্গায় লিপ্ত ছিলেন ও আছেন তার নাম বলেও শেষ করা যাবে না। এরচেয়ে ভয়ংকর অপরাধও দেখেও আমাদের চোখ সয়ে গেছে। বিডিআর বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা, নারায়নগঞ্জে সেভেন মার্ডার, বিশ্বজিত হত্যাকান্ড, ছাত্র নেতার ধর্ষনে সেঞ্চুরী, শেয়ার বাজার কেলেংকারী, বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হ্যাক করে কয়েক হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেয়া, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে তোলা— এমন সব মারাত্মক অপরাধও কিন্তু এতদিন আমাদের মূলধারার গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে “হট অব দ্য টপিক” বা ট্রেন্ডে অথবা মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে থাকেনি। আর এসব অপরাধের সাথে তুলনা করলে পরীমনি’র অপরাধ নিতান্তই নগন্য!

পরীমনি কাউকে খুন করেনি, কাউকে খুনের হুমকি দেয়নি, দুর্নীতি করে দেশের বা কারও কোটি কোটি টাকা মেরে দেয়নি, ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা লোন নিয়ে ঋনখেলাপি হয়নি, টাকা নিয়েও কোন পরিচালকের সিনেমা করেনি, জুয়ার আসর বা ক্যাসিনো গড়ে তুলেনি, পতিতালয় বানায়নি, কোন ব্যবসায়ীকে হাজার কোটি টাকার টেন্ডার পাওয়ে দেয়ার জন্য দালালী করেনি। বরং টাকা দিয়ে যারা সব কিনতে পারে বা বিক্রি হতে বাধ্য করে তাদের ভিক্টিম হয়েছেন পরীমনি।

তাহলে পরীমনির বিরুদ্ধে সবার এমনভাবে একাট্টা হওয়ার সবচেয়ে বড় কারন কি? মূল কারনটা হচ্ছে, পরীমনি অবশ্যই একজন অতি সুন্দরী ও রূরবতী নারী। তার রূপ ও সৌন্দর্য ব্যবহার করে যে সব রথি মহারথিরা পরীমনিকে ইচ্ছেমত ব্যবহার করে তারকা বানিয়েছিলেন—তাদের মধ্যেই পরীমনিকে নিয়ে দ্বন্ধের সৃষ্টি হয়েছে। আর এসব রথি মহারথিরা এতদিন এই ‘চরিত্র খারাপ’ মেয়েটাকে যেভাবে পারে ভোগ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এরই মধ্যে পরীমনি তারকা খ্যাতি পেয়ে যাওয়ায় হয়তো এসব রথি মহারথির নিয়ন্ত্রন ও শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে। এটাই পরীমনি’র জন্য কাল হয়ে গেছে। একপক্ষ পরীমনিকে ব্যবহার করে বোর্ডক্লাবে নাটক করিয়েছে। পরীমনি বোর্ডক্লাবে নাটক করার পর অন্যপক্ষের আতেঁ ঘাত লেগেছে। ফলে আতেঁ ঘা লাগা পক্ষ পরীমনিকে সাইজ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। পরীমনি দুই পক্ষের কৌশল ধরতে পেরে তাদের নিয়ন্ত্রন ও শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে গেছে। এতে দুই পক্ষই একাট্টা হয়ে পরীমনিকে পচিয়ে ফেলার জন্য যতসব কুট কৌশল ব্যবহার করা যায়, তার সবটাই প্রয়োগ করে সফল হয়েছেন। ফলে পরীমনি এখন একা ও অসহায় হয়ে পড়েছেন। রথি মহারথীদের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে কেউই এখন পরীমনি’র পক্ষ নিতে সাহস দেখাচ্ছে না। মিডিয়া ট্রাইলের ফলে পরীমনি এখন সবার কাছেই নষ্ট নারীতে পরিনত হয়েছে। ফলে এখন সবাই লিখে, কথা বলে, শেয়ার দিয়ে, মন্তব্য করে পরীমনি’র চরিত্রহনন করে শুধু মজাই লুটছেন না, নিজেদের অজান্তেই পরোক্ষভাবে অন্তরালে থাকা ঐ সব রথি মহারথির স্বার্থসিদ্ধ করছেন। হুজগে বাঙ্গালী তো এটা ভালোই পারে! এ আর বলার কি? তবে পরীমনি ইস্যুটি যে এতদিন ধরে দেশে “টক অব টপিক” বা ট্রেন্ডে বা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে তা নিয়ে সত্যিকার নিরপেক্ষ সাংবাদিকগণ দারুন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে পারেন আর সামাজিক গবেষক ও মিডিয়া একাডেমিকগণ ভালো গবেষনা করতে পারেন। এ ধরনের প্রতিবেদন ও গবেষনার ফলাফল ভবিষ্যতে অনেক কাজে দিবে, এটা আমি নিশ্চিত।