বৈশাখের উৎসব থাকলেও নেই হালখাতার আয়োজন

করোনার কারনে গেলো দুবছর বৈশাখের আনন্দ বা উৎসব থেকে অনেকটাই দুরে থাকতে হয়েছে। আর এবার বাংলা নববর্ষ কাটছে মাহে রমজান মাসে। এর পরেও উৎসব আয়োজনের কোন কমতি নেই তা বলা যেতেই পারে। তবে বৈশাখের মুলমন্ত্র বা বড় আয়োজন হালখাতা এখন আর তেমনভাবে হয় না। একথায় বলা যেতে পারে নতুনবছরের সাথে সাল যুক্ত হবার সাথে সাথে আয়োজনে যুক্ত হচ্ছে ভিন্ন মাত্রা। দীর্ঘদিন থেকে এ অবস্থা চলে আসছে। ফলে একদিকে বৈশাখের উৎসব মহাসমরে উদযাপন করা হলেও হালখাতার হারিয়ে যেতে বসেছে। এবারো হালখাতার তেমন আয়োজন নেই। এতে করে বর্তমান প্রজন্ম হালখাতা শব্দটির সাথে তেমন পরিচিত হতে পারছে না। এমন দাবি করছেন সুধিজনেরা।

তবে বর্তমান সময়ে পহেলা বৈশাখে হালখাতা না হলেও ইংরেজী মাস হিসেবে জুন অথবা ডিসেম্বর মাস হিসেবে বেশী হয়। এছাড়াও বোরো বা রোপা আমন ধান কাটা মাড়াই হলে ব্যবসায়ীরা হালখাতা করে থাকেন। হিন্দু ব্যবসায়ীরা অনেকেই এখনও আগের ধারাবাহিকতায় চৈত্র সংক্রান্তি থেকে শুরু করে পহেলা বৈশাখের পরের দিন পর্যন্ত হালখাতা করেন। পরিসংখ্যানগতভাবে এর সংখ্যা অনেক কম। হালখাতা শহরে তেমনভাবে না হলেও প্রত্যান্ত গ্রামাঞ্চলে এর আয়োজন বেশী হতো। দোকানে টাকা পরিশোধ করতে গেলে মিলত মতিচুরের লাড়ু–, বাতাসা, জিলাপি এসব জাতীয় খাবার। সকলের উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রাণ। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে ‘হালখাতা’র সামাজিক গুরুত্বও ছিল ব্যাপক।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের মূল আয়োজন থাকতো হালখাতাকে ঘিরেই। দু’দশক আগেও বৈশাখের প্রথম দিনে গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারে অবস্থিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা মূলত এর আয়োজন করতো।

বিশেষ করে আড়ত ও দোকানগুলোতে হালখাতার যে জাঁকজমক অনুষ্ঠান দেখা যেত, তা এখন আর নেই। আগে ব্যবসায়ীরা মুখের কথায় বিশ্বাস করে টালি খাতায় লিখে রেখে লাখ লাখ টাকা বাকি দিতেন। তার বেশিরভাগই উসুল হতো হালখাতার দিনে। এখন লেনদেনটা অনেকে ব্যাংকের মাধ্যমে চুকিয়ে নেন।

অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা সাদা অথবা হলুদ রংয়ের কার্ডের মাধ্যমে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি হালখাতার দাওয়াত দিতেন। সেই দাওয়াতপত্রে বকেয়া অর্থের কথা উল্লেখ থাকতো। আর পহেলা বৈশাখের আগের দিন গভীর রাত পর্যন্ত রং বেরংয়ের কাগজের নকশা দিয়ে সাজানো হতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে। সকাল থেকেই প্রতিটি মানুষ তাদের পাওনা পরিশোধ করতে দোকানে আসতেন। তা চলতো রাত পর্যন্ত। আর প্রতিষ্ঠানের মালিকরা মতিচুরের লাড়–ুসহ বিভিন্ন মিষ্টি জাতীয় খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করতেন আগত ক্রেতাদের।

ঐতিহাসিকদের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, বাংলা নববর্ষের উৎসবের অন্যতম আয়োজন ছিল রাজপুণ্যাহ ও হালখাতা। ১৯৫০ সালে জমিদার প্রথা বন্ধ হয়ে গেলে পুণ্যাহ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। আর হালখাতা টিকে থাকলেও নতুন যুগে তার অবস্থাও মলিন। পুণ্যাহ ছাড়া পয়লা বৈশাখের আরেকটি অনুষ্ঠান অল্পকিছু পরে চালু হয়েছিল, সেটি হালখাতা। গ্রামের কৃষকেরা সাধারণত তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের কেনাকাটা করতেন বাকিতে। ফসল ঘরে উঠলে তাঁরা ফসল দিয়েই ঋণ শোধ করতেন। মুদি দোকানিরা লম্বা খাতায় ক্রেতাদের নাম লিখে রাখতেন।

বছরের শুরুতে পুণ্যাহর অনুসরণে নিজ নিজ দোকানে আমন্ত্রণ জানাতেন তাদের। ক্রেতারা পুরোনো বকেয়া শোধ করে কিছু আগাম হিসেবেও কিছু শস্য দিতেন। এ দিন বেচাকেনা তেমন হতো না।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, তার বাবা-দাদারা প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ হালখাতার আয়োজন করতেন। কিন্ত এখন তা করা হয়না। কারন ব্যবসায় ধার-বাকিতে কাপড় দেয়া হলেও এক মাস বা দুমাস পরেই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তা পরিশোধ করে দেন। তবে বছরের যে কোন সময় একবার হালখাতার আয়োজন করা হয়। তা কেবল ব্যবসায়ীদের নিয়ে একদিন একটু কোন বড় রেষ্টুরেন্টে অনুষ্ঠানের জন্য।

সুধিজনেরা বলছেন মানুষের রুচির এবং চাহিদার পরিবর্তন হয়েছে। মুলত আধুনিকতার ছোঁয়ায় এই পরিবর্তন এনেছে। ক্রেডিট কার্ড, ক্যাশ প্রেমেন্ট, অনলাইনের মাধ্যমে অনেকে এখন পন্য কিনে থাকেন। তাছাড়াও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আগের মত দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া রাখতে চান না। বড় অংকের বকেয়া হবার আগেই আদায়ের চেষ্টা করেন। তাছাড়া ক্রেতারা এখন যে কোন সময় বকেয়া পরিশোধ করে থাকেন। ফলে আগের মত সেইভাবে হালখাতা অনুষ্ঠানের তেমন আয়োজন হয়না।

এসএইচ-০২/১৪/২২ (সুমন হাসান)