তপ্ত দুপুর, মাথার ওপর সূর্যের তীর্যক রশ্মি। অসহ্য তাপদাহের মধ্যে মাথায় ইটের স্তূপ নিয়ে ছুটছেন আকলিমা আক্তার। ঢাকার অদূরে গাজীপুরের জয়দেবপুরে একটি নির্মানাধীন ভবনে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করে মেলে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। তিনি বলেন, কোনো রকমে বেঁচে থাকতেই এমন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। স্বামী আছে, কিন্তু অক্ষম। তাই সংসারের হাল ধরেছেন। সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নারী– এমন উদাহরণ এখন ভুরি ভুরি।
এক সময় নারীদের ঘর থেকে বের হওয়াই কঠিন ছিল। এখন বদলে গেছে চিত্র। ঘরের চার দেয়ালের গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে নারীরা এখন অফিস-আদালতে, মাঠে-ঘাটে, ইটভাটায়, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিসহ নানাক্ষেত্রে কাজ করছে। পেশাজীবনের নিম্ন থেকে উচ্চ সব পর্যায়ে এখন নারীর পদচারণা। পুরুষের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে চলেছে নারী। দেশে তথা বিশ্বে কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়ছে। অর্থাৎ অর্থনীতিতে বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ। বাণিজ্য, উৎপাদন, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষা– সবক্ষেত্রে অদম্য নারী। তবে সরকারি বা বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে আজও লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ন্যায্য মজুরি ও পদোন্নতি পাচ্ছেন না, কাজের যথাযথ মূল্য পাচ্ছেন না তারা। অনেকে মুখে অনেক বুলি আওড়ায়। নারীর অধিকার, মজুরিসহ নানা বিষয়ে সমঅধিকার নিয়ে অনেক সভা-সেমিনার হয়ে থাকে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। দেশে নারীদের জন্য এখনও একটি সুস্থ ও সুন্দর কর্মপরিবেশ গড়ে ওঠেনি, আমরা গড়ে তুলতে পারিনি, যা দুঃখজনক বিষয়।
শ্রমশক্তির বিরাট অংশ নারীশ্রমিক হওয়া সত্ত্বেও তাদের ভাগ্যের এখনও খুব একটা উন্নতি ঘটেনি। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারীদের অনেকেই বলছেন, তারা বেতন কাঠামো, প্রমোশন, ইনক্রিমেন্ট প্রাপ্তির দিক থেকে বৈষম্যের শিকার। কর্মস্থলে দিনভর হাড়ভাঙা শ্রম দিয়েও মেলে না ন্যায্য মজুরি। এর চেয়েও বড় শঙ্কা হচ্ছে- নারীদের কর্মপরিবেশ অনিরাপদ। পথে-ঘাটেও নিরাপত্তার অভাব। শুধু পুরুষদের সহযোগিতার অভাবে এভাবেই সর্বত্র তৈরি হচ্ছে নারীকেন্দ্রিক বৈষম্য।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৪৩টি খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের সুযোগ আছে। অনেক খাতে তা ঘোষণাও করা হয়েছে। কিন্তু পোশাক শিল্পসহ কয়েকটি খাত ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। অথচ বাংলাদেশে শিল্প-কারখানায় কর্মরত শ্রমিকের ৫০.৪ শতাংশই হচ্ছেন নারীশ্রমিক।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়ছে, কেবল লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষদের উপার্জনের ক্ষেত্রে বড় ব্যবধান তৈরি হয়েছে। নিম্ন আয়ের দেশের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য আরও বেশি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতি হলেও মজুরি বৈষম্য যথাযথভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। মজুরি বৈষম্য নারী ক্ষমতায়নের পথে অন্তরায়। তাই প্রথমেই একটি মজুরি কাঠামো গঠন করতে হবে এবং নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য হ্রাসে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি চাকরি তথা আনুষ্ঠানিক খাতে নারী-পুরুষের বেতন-বৈষম্য অনেকটা কম হলেও অনানুষ্ঠানিক খাতে বৈষম্য এখনো তীব্র। গবেষক, নারী উদ্যোক্তা এবং সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে- সর্বস্তরের আয়বৈষম্য নিরসন করা এখনও বাংলাদেশে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সমাজের বিভিন্ন স্তরে নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে, পদায়ন হয়েছে, নারী-পুরুষের সমন্বয়ে কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রান্তিক পর্যায়ে এ বাস্তবতা ভিন্ন। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন খাতে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। এমনকি কোনো কোনো কাজে পুরুষের চেয়ে বেশি শ্রম ও মেধা দিয়েও সমান মজুরি পাচ্ছেন না। কেবল ব্যক্তিমালিকানাধীন বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেই নয়, সরকারি প্রতিষ্ঠানেও মোটামুটি একই চিত্র দেখা যায়।
দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা প্রতিদিন গড়ে ৬ ঘণ্টা মজুরি ছাড়া গৃহস্থালির কাজ করেন। অন্যদিকে পুরুষরা বয়সভেদে গড়ে দৈনিক দেড় থেকে দুই ঘণ্টা এ কাজ করেন। অর্থাৎ নারীকে পুরুষের তুলনায় তিনগুণ বেশি শ্রমব্যয় করতে হয়। তাই নারীর শ্রমের মূল্যায়ন করা সময়ের দাবি।
এআর-০৬/২৮/১২ (মারিয়া বিনতে মতিন)