‘চিৎকার করো মেয়ে দেখি কতদূর গলা যায়/ আমাদের শুধু মোমবাতি হাতে নীরব থাকার দায়।’ ⎯ কথাগুলো বারবারই মনে পড়ে যায়, যখন চারদিকে প্রতিদিনই নারীদের প্রতি সহিংসতার চিত্র দেখা যায়। একেবারে পরিবার থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাঙ্গন কোথাও বাদ যাচ্ছে না এই আগ্রাসী থাবা। নারীর প্রতি সহিংসতার খুব লম্বা ইতিহাস রয়েছে, যদিও এরকম সহিংসতার মাত্রা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছিল, এমনকি আজও বিভিন্ন সমাজে এগুলোর মাত্রা ও ঘটনার ধরন বিভিন্ন হয়। এরকম সহিংসতাকে প্রায়ই নারীকে সমাজে বা আন্তঃব্যক্তি সম্পর্কে অধীনস্থ করার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আমাদের দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা এবং প্রকোপ এতই বেশি যে, তা অন্য যেকোনো দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। নারীর প্রতি সহিংসতার রূপগুলোর মধ্যে বলা যায়⎯ খুন, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ বা নিপীড়নের হুমকি, বাল্যবিয়ে, যৌতুক, গৃহ নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা প্রজননগত জোর-জবরদস্তি, কন্যা শিশুহত্যা, লিঙ্গভিত্তিক গর্ভপাত, প্রসবকালীন সহিংসতা, উচ্ছৃঙ্খল জনতার দ্বারা সহিংসতা বা দাঙ্গা, নারী পাচার এবং জোরপূর্বক বেশ্যাবৃত্তিসহ আরও অনেকভাবেই সহিংসতার শিকার হতে হয় আমাদের দেশের নারীদের। বর্তমান সময়ে, বিশেষ করে গত কয়েক বছরে গণমাধ্যমগুলো থেকে আমরা ধর্ষণসহ নারীর প্রতি বিভিন্ন প্রকার সহিংসতার যেসব খবর জানতে পেরেছি, তা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এই সহিংসতা এখন মহামারির রূপ নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় কিশোরী নির্যাতনের শীর্ষে বাংলাদেশ, আর সারা বিশ্বে সপ্তম। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)-এর গবেষণায় এরকমই তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘হিডেন ইন প্লেইন সাইট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রদান করা হয়েছে। ১৯০টি দেশ থেকে এই গবেষণার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণায় বলা হচ্ছে, স্বামী বা সঙ্গীর নিপীড়নের ক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। আর দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সবার শীর্ষে। একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষ, বন্ধু, যাই বলি না কেন, সেটা হলো তার স্বামী/স্ত্রী। আর সেই সম্পর্কের জায়গাতেই সমস্যার শীর্ষে আমরা। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের জন্য গত তিন দশকে বাংলাদেশে নানাবিধ আইন হয়েছে। কিন্তু তারপরও কমছে না নারীর প্রতি সহিংসতা।
বাংলাদেশে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দেশটিতে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকলেও নারীর প্রতি সহিংসতা কমছে না, বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিবারে এবং অনলাইনে নারী নির্যাতন বেড়েছে। তারা আরও বলছেন, এই সহিংসতা বন্ধের জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগ যেমন দরকার, তেমনি সামাজিক সচেতনতাও প্রয়োজনীয়।
বাংলাদেশে পুলিশের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, গত পাঁচ বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার মামলা কমেনি।
নারী অধিকার কর্মীরা বলছেন, পরিবারে নারীর প্রতি সহিংসতা যেমন বাড়ছে, তেমনি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনলাইনে এই হয়রানির মাত্রা বেড়েছে।
সরকার বলছে, নারী নির্যাতন মামলার বিচার দ্রুত করার জন্য ট্রাইব্যুনাল এবং বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে রাষ্ট্রের এত এত উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব হচ্ছে না। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকার অনেক আইন তৈরি করেছে। যেমন⎯ বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯, নারী ও প্রগতি ৫৩, যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩), অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২ (সংশোধনী ২০১০), নারীর প্রতি সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, জাতীয় শিশুনীতি ২০১১, জাতীয় নারীনীতি ২০১১, নারী নির্যাতন প্রশমনে মাল্টি সেক্টরাল প্রোগ্রাম ইত্যাদি। কিন্তু কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না এই সহিংসতা। এক ধরনের সহিংসতা কমলে অন্য ধরনের সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। আর এই কর্মসূচির লক্ষ্য হতে হবে কারণগুলোর মূলোৎপাটন করা। তাই সরকার, প্রশাসন, বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের সমন্বিত উদ্যোগ আর আইনের সুষ্ঠ প্রয়োগ ও কঠোর শাস্তির বিধানের মাধ্যমে এটা নির্মূল করা সম্ভব।
এআর-০৪/২৯/১২ (মারিয়া বিনতে মতিন)