‘শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে জ্ঞানার্জনে, লাশ হয়ে বাড়ি ফিরার জন্য নয়’

সম্প্রতি দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে ‘অমানবিক’ ও ‘অনভিপ্রেত’ উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, এসব ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও শিক্ষার্থীদের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা জ্ঞান অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়, লাশ হয়ে কিংবা বহিষ্কৃত হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য নয়। কর্তৃপক্ষ সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নিলে এসব অপ্রত্যাশিত ঘটনা অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হতো। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর দায় একেবারে এড়াতে পারে না। আশা করবো ভবিষ্যতে কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নেবে।

সোমবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সমাবর্তন বক্তা ছিলেন পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কসমিক রে রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. তাকাকি কাজিতা। তাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব সায়েন্স’ ডিগ্রি প্রদান করা হয়।

অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান, প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ, প্রো-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. সামাদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দীনসহ মন্ত্রীবর্গ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, সিনেট-সিন্ডিকেট সদস্য, শিক্ষক ও সমাবর্তন প্রত্যাশী গ্র্যাজুয়েটরা উপস্থিত ছিলেন। দুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে সমাবর্তনের অনুষ্ঠান শুরু হয়।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, শিক্ষার মূল লক্ষ্য জ্ঞানার্জন হলেও তা একমাত্র লক্ষ্য নয়। কারণ কর্মবিমুখ শিক্ষা মূল্যহীন। শিক্ষাকে কার্যকর করতে হলে এর সঙ্গে কর্মের সংযোগ ঘটাতে হবে। তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার বিশ্বকে দ্রুত বদলে দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যে জাতি যত বেশি খাপ খাইয়ে নিতে পারছে, সে জাতি তত বেশি উন্নতি করছে। আর এই পরিবর্তনের মুখ্য ভূমিকা রাখে যুবসমাজ। তারা হচ্ছে জাতির ‘চেঞ্জমেকার’।

প্রতিবছর সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ডিপার্টমেন্ট, ইভিনিং কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও ইনস্টিটিউটের ছড়াছড়ি। নিয়মিত কোর্স ছাড়াও এসব বাণিজ্যিক কোর্সের মাধ্যমে প্রতিবছর হাজার হাজার গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে। এসব ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষার্থীরা কতটুকু লাভবান হচ্ছে এ ব্যাপারে প্রশ্ন থাকলেও এক শ্রেণির শিক্ষক কিন্তু ঠিকই লাভবান হচ্ছেন। তারা নিয়মিত নগদ সুবিধা পাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করছেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের পাশাপাশি সার্বিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন দিনে সরকারি আর রাতে বেসরকারি চরিত্র ধারণ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সন্ধ্যায় মেলায় পরিণত হয়। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আবার কিছু শিক্ষক আছেন যারা নিয়মিত কোর্সের ব্যাপারে অনেকটা উদাসীন। কিন্তু ইভিনিং কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে তারা খুবই সিরিয়াস। কারণ এগুলোতে নগদপ্রাপ্তি থাকে। মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয় চলে জনগণের টাকায়। সুতরাং এর জবাবদিহিও জনগণের কাছে। জনগণের এই অর্থে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের যেমন ভাগ আছে তেমনই ভাগ আছে কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা পয়সা সততার সঙ্গে সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়িত্ব উপাচার্য ও শিক্ষকদের। উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অভিভাবক ও একাডেমিক লিডার। কিন্তু কোনো কোনো উপাচার্য ও শিক্ষকের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল কাজ কী তা ভুলে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শুধু জ্ঞান দান করা নয়। বরং অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগানোই হচ্ছে আসল কাজ। গবেষণা হচ্ছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক কাজ।

তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান নিয়েও নানা কথা ওঠে। পদোন্নতির জন্য গবেষণা, না মৌলিক গবেষণা তাও বিবেচনায় নিতে হবে। অনেক বিভাগেই এখন অন্যান্য পদের শিক্ষকের চেয়ে অধ্যাপকের সংখ্যা বেশি। অনেক শিক্ষকই প্রশাসনিক পদ-পদবি পেয়ে নিজে যে একজন শিক্ষক সে পরিচয় ভুলে যান।

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আবদুল হামিদ বলেন, তোমাদের মা-বাবা অনেক আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। এমন অনেক পরিবার আছে যারা সর্বস্ব দিয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। তোমাদের মূল দায়িত্ব হলো লেখাপড়া করা এবং দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলা। তোমারা এমন কোনো কাজ করবে না যাতে তোমাদের পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়। সবসময় মনে রাখতে হবে, তোমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে লেখাপড়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা, নিজেকে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। আর পরবর্তীতে পরিবারসহ দেশের জন্য ভালোকিছু করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগামী সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধুকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদানের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি। এ সময় তিনি বলেন, ডাকসু নির্বাচন দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রশাসনকে আমি অনুরোধ করেছিলাম। তারা আমার কথা রেখেছেন। তবে এই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভবিষ্যতে যেন নির্বাচন নিয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠে এবং এটি যেন আরো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় সেই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে খেয়াল রাখতে হবে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, বর্তমান ডাকসুর বিষয় নিয়ে আমার কথা বলার কথা না। এ নিয়ে কথা বলা উচিত ছাত্র নেতৃবৃন্দের। কিন্তু তারা তো কথা বলেনই না বরং তাদের নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়। আমার এসব ভালো লাগে না। তাদের কাছ থেকে আমি ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা শুনতে চাই।

তিনি আরও বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার কথা বলেছিলাম। সে বিষয়ে কোনো অগ্রগতি দেখিনি। এ বিষয়ে কাজ করতে আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।

ঢাবি ফার্মেসি অনুষদ ও অধিভুক্ত মেডিকেল কলেজের গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বর্তমানে লক্ষ্য করেছি, এদেশের ওষুধ তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো ভালোমানের ওষুধ বিদেশে পাঠায় আর কম মানসম্পন্ন ওষুধগুলো ঢাকার জন্য রাখে। অন্যদিকে, আরো কম মানের ওষুধগুলো মফস্বলে পাঠায়। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন হতে হবে। তা না হলে জাতি গভীর সঙ্কটে পড়বে।

এর আগে শোভাযাত্রার মাধ্যমে সমার্বনস্থলে প্রবেশের মাধ্যমে এর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি অনুষ্ঠানস্থলে আগমনের সঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয়। পরে রাষ্ট্রপতি সমাবর্তনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

এবারের সমাবর্তনে ২০ হাজার ৭৯৬ জন গ্র্যাজুয়েট অংশগ্রহণ করেন। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ৭৯ জন কৃতী শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীকে ৯৮টি স্বর্ণপদক, ৫৭ জনকে পিএইচডি, ৬ জনকে ডিবিএ এবং ১৪ জনকে এমফিল ডিগ্রি প্রদান করা হয়।

বিএ-১২/০৯-১২ (শিক্ষা ডেস্ক)