সংগঠন থাকলেও শিক্ষক নির্যাতনে প্রতিবাদ কম

বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দুশ’রও বেশি সমিতি আছে৷ শিক্ষকদের ওপর হামলা-নির্যাতনের প্রতিবাদ, দোষীদের আইনের আওতায় আনার বিষয়ে তারা কতটা তৎপর?

সব পর্যায়ের শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো- এই সমিতিগুলো দলীয় রাজনীতির কারণে বিভক্ত৷ নেতারা নানা স্বার্থ নিয়ে ঘোরেন৷ পদ,পদবি, পদোন্নতিসহ নানা বিষয় নিয়ে তারা ব্যস্ত থাকেন৷ তাই শিক্ষক সমিতিগুলো শিক্ষকদের বিষয় নিয়ে কাজ করার তেমন সময় পায় না৷

আরেকটি বিষয় হলো, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক নির্যাতনের শিকার হলে অন্য পর্যায়ের শিক্ষক নেতারা প্রতিবাদের ভারও প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপরই ছেড়ে দেন৷ মাধ্যমিকের ক্ষেত্রেও অন্যরা একই রকম চিন্তা করেন৷ কোনো মাদ্রাসা শিক্ষক নির্যাতনের শিকার হলে বাকিদের তা নিয়ে তেমন আগ্রহই দেখা যায় না৷ তবে সবাইর কথা হলো, ‘‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ম্যানেজিং কমিটি ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে জিম্মি৷ তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলে চাকরিই তো থাকে না৷ তারপর প্রতিবদী হলে তো আরো বিপদ৷’’

প্রাথমিক শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি৷ সমিতির সভাপতি মো. আবুল কাশেম বলেন, ‘‘শিক্ষকদের ওপর কোনো অন্যায় হলে প্রতিবাদ হয়৷ কিন্তু সেই প্রতিবাদটা জোরালো নয়৷ এর কারণ শিক্ষকদের সব সংগঠন প্রতিবাদ করে না৷ শিক্ষক সে প্রাইমারি, হাইস্কুল বা মাদ্রাসা যে প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষক হোক না কেন, সে শিক্ষক৷ সেটাই তার পরিচয়৷ কিন্তু দেখা যায়, প্রাইমারির কোনো শিক্ষক নির্যাতনের শিকার হলে অন্যরা সেটা নিয়ে কথা বলে না৷ মাদ্রাসা শিক্ষক লাঞ্ছিত হলে অন্যরা মনে করেন, সে তো মাদ্রাসা শিক্ষক৷ আমাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কোনো সময় প্রতিবাদ করতে দেখি না৷ সবাই মিলে প্রতিবাদ করলে এই পরিস্থিতি হতো না৷’’

তিনি মনে করেন, এখন শিক্ষকদের যে দুইশরও বেশি সংগঠন আছে, সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক স্বার্থে কাজ করে৷

মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের সংগঠন স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু বলেন, ‘‘শিক্ষকরা যে কার্যকর প্রতিবাদ করছেন না, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ কিন্তু বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এখন ম্যানেজিং কমিটির হাতে জিম্মি৷ কমিটিগুলো দলীয় নেতা এবং এমন লোকের হাতে চলে গেছে, যাদের সুশিক্ষিত বলা যাবে না৷ তাদের পেশি শক্তি, রাজনৈতি শক্তি সবই আছে৷ ফলে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শিক্ষক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানরা যেতে পারেন না৷ নড়াইলে পুলিশ ও প্রশাসনের সামনেই শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানো হলো৷ তারা কোনো ব্যবস্থা নিলেন না৷ তাদের ছত্রচ্ছায়ায়ই ঘটনা ঘটলো৷ এতেই বোঝা যায়, প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তারা শিক্ষকদের কী চোখে দেখেন৷’’

তার কথা, ‘‘রাষ্ট্রীয়ভাবেও শিক্ষকরা অবহেলিত ও বৈষম্যের শিকার৷ তারই প্রতিফলন এখন আমরা স্থানীয় পর্যায়ে দেখতে পাচ্ছি৷”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আশুলিয়ায় শিক্ষক হত্যার পর আমরা সেখানে গিয়েছি৷ প্রতিবাদ সমাবেশ করেছি৷ নারায়ণগঞ্জেে শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবসের ঘটনার পরও আমরা সেখানে গিয়েছি৷ নড়াইলে জুতার মালা পরানোর পরও আমরা গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছি৷”

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম রনি বলেন, ‘‘ম্যানেজিং কমিটির কারণে আমি নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত৷ আমাকে আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে৷ ম্যানেজিং কমিটি খড়গের মতো৷ শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করানো হয়েছে একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্যের সামনে৷ ভয়ে শিক্ষকরা প্রতিবাদ করতে পারেনি৷ আশুলিয়ায় নিহত শিক্ষককে হত্যার উদ্দেশ্যে যখন পিটানো হয়, তখন আরেকজন শিক্ষক ওই ছাত্রকে জাপটে ধরেছিল৷ কিন্তু ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিসহ আরো অনেকে তার আত্মীয় হওয়ায় তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়৷”

তবে শিক্ষকের মর্যাদাহানির ঘটনায় সমিতিগুলোর খুব বেশি প্রতিবাদমুখর না হওয়ার কারণ হিসেবে রাজনীতিকেও দুষেছেন তিনি, ‘‘শিক্ষকরাও এখন দলীয়ভাবে বিভক্ত৷ অনেক সমিতিই আছে যারা দলীয় স্লোগান দিয়ে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করে৷ শিক্ষক নেতারা যদি রাজনীতি করেন, দলীয় স্লোগান দেন, দালালি করেন, তাহলে তো তাদের নৈতিক অবস্থান এমনিতেই দুর্বল হয়ে যায়৷’’

আশুলিয়ায় শিক্ষক নিহত হওয়ার পর এই সংগঠনের নেতারা কেউ সেখানে যাননি বা নিহত শিক্ষক উৎপল সরকারের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেননি৷ তারা নড়াইলেও যাননি৷ এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম রনি বলেন, ‘‘শ্যামল কান্তিসহ অন্য শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনায় আমরা গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছি৷ তবে পুলিশ বা প্রশাসন আমাদের প্রতিবাদকে তেমন গুরুত্ব দেয় না, আমলে নেয় না৷ তারা প্রভাবশালীদের কথায় কাজ করে৷’’

মাদ্রাসা শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদারেসিনের মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা সাব্বির আহমেদ মমতাজি মনে করেন, ‘‘শিক্ষকদের মূল কাজ ছাত্রদের পড়াশোনা করানো৷ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে তাদের ভূমিকা গুরত্বপূর্ণ৷ কেউ কেউ এই মূল কাজ বাদ দিয়ে ব্যক্তি স্বার্থে নানা সমিতি করে, রাজনীতি করে৷ এটা ঠিক না৷ শিক্ষক নির্যাতনের প্রতিবাদ যে হয়না তা নয়৷ তবে যত সমিতি তত প্রতিবাদ দেখি না৷”

শিক্ষকদের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নিজামুল হক ভুঁইয়ার কাছে প্রশ্ন ছিল, ‘‘আশুলিয়ায় শিক্ষক নিহত হওয়ার পর আপনারা কী করেছেন?’’ জবাবে তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা একটি স্টেটমেন্ট দিয়েছি৷”

শিক্ষক সংগঠনগুলো বাস্তবে এখন বিবৃতি এবং ফেসবুক প্রতিবাদেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে৷ শিক্ষক নেতারা এজন্য সামাজিক অবক্ষয় এবং রাষ্ট্রের উদাসীনতাকে দায়ী করেন৷

অধ্যাপক নিজামুল হক ভুঁইয়া বলেন, ‘‘শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করিয়েছেন একজন সংসদ সদস্য৷ তার কোনো বিচার হয়নি৷ ফলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে৷ একজন শিক্ষককে লাঞ্ছনাকারী যতই প্রভাবশালী হোক, রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে না?”

এসএইচ-০৩/০২/২২ (শিক্ষা ডেস্ক, সূত্র : ডয়চে ভেলে)