ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে!

কোনো নীতিমালা ও নজরদারির অভাবে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে ভর্তি ও টিউশন ফি হিসেবে মাত্রাতিরিক্ত টাকা নেওয়া হচ্ছে। ফলে মধ্যবিত্তসহ সব অভিভাবকের পক্ষে এসব স্কুলে সন্তানের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া যেন এক নিরন্তর সংগ্রামে পরিণত হয়েছে।

এসব স্কুলের ওপর সরকারের কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। এমনকি এ পর্যন্ত এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে কোনো ধরনের উদ্যোগও দেখা যায়নি। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় স্কুলগুলো তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী অর্থ আদায়ের সুযোগ পাচ্ছে।

আহমেদ রায়হানের ছেলে ধানমন্ডির একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করে। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের স্কুল প্রতি বছর ফি বাড়াচ্ছে এবং একইসঙ্গে বই ও স্টেশনারির দামও বাড়ছে। মনে হচ্ছে এসব দেখার কেউ নেই।’

করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অনেক অভিভাবকের জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গেছে। অনেকে বাড়তে থাকা খরচের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে সন্তানের লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন।

বাড়তে থাকা খরচের কারণে ২০২০ সালের শেষের দিকে অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী সাদমানের (ছদ্মনাম) স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

সে বলে, ‘আমার বাবা মহামারির সময় ব্যবসায় বড় ক্ষতির মুখে পড়েন। তিনি আর আমার স্কুলের খরচ দিতে পারছিলেন না। ফলে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ও-লেভেল পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করি।’

সে আরও বলে, ‘বছরে ভর্তি ফি ২ লাখ টাকার পাশাপাশি প্রতি মাসে ২৪ হাজার টাকা টিউশন ফি দিতে হতো। এ ছাড়াও, কোচিং সেন্টার, বই ও স্টেশনারিসহ আরও বেশ কয়েক ধরনের খরচ রয়েছে।’

সংবাদমাধ্যম ধানমন্ডি, গুলশান ও উত্তরার ৮টি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রশাসনিক অফিসে কথা বলে জানতে পেরেছে, স্কুলগুলোর ভর্তি ফি প্রতি বছর দেড় লাখ থেকে ৩ লাখ টাকার মধ্যে। কিছু প্রতিষ্ঠানে এই ফি বছরে ৫ লাখ টাকারও বেশি।

বেশিরভাগ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের মাসিক টিউশন ফি ৮ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে থাকে। ভর্তি ফি ও টিউশন ফির পাশাপাশি আরও বেশ কয়েক ধরনের আনুষঙ্গিক খরচ রয়েছে।

প্রতি শিক্ষাবর্ষের শুরুতে শিক্ষার্থীদের বই, স্কুলের ইউনিফর্ম ও সব ধরনের স্টেশনারি পণ্য কিনতে হয় এবং তা স্কুলের নির্ধারণ করে দেওয়া সুনির্দিষ্ট কিছু দোকান থেকেই। কোন ক্লাসে অধ্যয়ন করছে, সেই অনুযায়ী এই খাতেও প্রতিটি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের বড় অংকের টাকা খরচ হয়।

ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, ‘৫৬টি নোটবুক, ১৮টি বই, অনেকগুলো কলম, পেনসিল, এমনকি টিস্যু বক্সও কিনে স্কুলে জমা দিতে হয়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা এসব উপকরণ আমার ছেলের আইডি নম্বরের বিপরীতে সংরক্ষণ করবে এবং প্রয়োজনীয় সময়ে তাকে এগুলো দেবে।’

‘আমার ধারণা, তারা আমাদেরকে জোর করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস কিনতে বাধ্য করেছে এবং এ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আয় করেছে,’ যোগ করেন তিনি।

এরপর আসে কোচিং সেন্টারের খরচ।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেকগুলোই মানসম্পন্ন শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে অসংখ্য শিক্ষার্থীকে কোচিং সেন্টারে যেতে হচ্ছে।

এ ছাড়াও, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর জন্য কোনো শীর্ষ সংস্থা নেই, যেখানে অভিভাবকরা অভিযোগ জানাতে পারেন।

বাংলাদেশ ইংরেজি মাধ্যম স্কুল অভিভাবক ফোরামের সভাপতি একেএম আশরাফুল হক বলেন, ‘বেশিরভাগ ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান ও অর্থনীতির মতো বিষয়ের জন্য কোচিং সেন্টারের ওপর নির্ভর করতে হয়। আমরা প্রতি বিষয়ের জন্য ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা করে দেই।’

একটি সাধারণ মানের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সন্তানকে পড়াতে প্রতি বছর গড়ে ২ থেকে ৪ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। মোট ১২ বছরের শিক্ষায় এই বাবদে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করতে হয়।

আশরাফুল আরও বলেন, ‘বাংলা মাধ্যম স্কুলের মান কমছে। সেইসঙ্গে সার্বিকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার অবনতির কারণে অনেক মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাঠাচ্ছেন। সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাবে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।’

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নিবন্ধন দিলেও এই স্কুলগুলোর ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

ঢাকার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের তথ্য মতে, ঢাকায় প্রায় ৪ হাজার ৫০০ ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থাকলেও, বোর্ডে নিবন্ধন করেছে মাত্র ১৪২টি।

বোর্ড চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘এটা সত্য যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বেশিরভাগ ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নিবন্ধিত নয়। প্রকৃতপক্ষে, আইনি ও সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার কারণে আমরা এসব স্কুল নিয়ন্ত্রণ করতে বা এদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারি না।’

‘যখন কোনো স্কুল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে, আমরা তাদেরকে জাতীয় শিক্ষা নীতি-২০১০ অনুযায়ী বাংলা ও বাংলাদেশ বিষয়ক শিক্ষা দেওয়ার বাধ্যবাধকতার কথা জানাই। যদি তারা এই নির্দেশনা মেনে চলে, তাহলে আমরা তাদের নিবন্ধন দেই। তবে যেহেতু ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার বিষয়ে কোনো আইন নেই, তাই এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ ও নিরীক্ষণ করার মতো সাংগঠনিক প্রক্রিয়া ও সক্ষমতা আমাদের নেই,’ যোগ করেন তিনি।

তিনি আরও জানান, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ইংরেজি মাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করছে এবং এর কাজ শেষ হতে আরও ১ বছরের মতো সময় লাগবে।

২ শিক্ষার্থীর রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ২৩ এপ্রিল হাইকোর্ট ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোকে সেশন ফি অথবা পুনরায় ভর্তির ফি নেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। এরপর ২০১৭ সালের ২৫ মে হাইকোর্টের রায়ে সেশন অথবা পুনরায় ভর্তির ফিয়ের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল পরিচালনার জন্য ১৭টি নীতিমালা প্রণয়ন করে।

তবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত বছরের ৩ জানুয়ারি হাইকোর্টের ১৭টির মধ্যে ১৬টি নির্দেশনায় স্থগিতাদেশ দেয়। স্থগিতাদেশের বাইরে থাকা একমাত্র নির্দেশ ছিল স্কুলগুলোতে বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উদযাপন করা।

এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হতবাক করে দেয় এই স্থগিতাদেশ।

আশরাফুল বলেন, ‘ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো এখন বিধি-নিষেধ না থাকায় সেশন ফি ও অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ফি আদায় করছে। এই স্কুলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারের উদ্যোগ বেশ গতিবেগ সঞ্চার করেছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের রায়ের পর পুরো বিষয়টি ঝিমিয়ে পড়ে।’

বিশেষজ্ঞরা ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার সংস্কার ও একে নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনার বিষয়ে মত প্রকাশ করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন, ‘সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কীভাবে দেশের নাগরিকদের শিক্ষা দেবে। এটা কী সেবা হিসেবে দেওয়া হবে, নাকি পণ্য। আমাদের সংবিধান ও আইন অনুযায়ী, শিক্ষা একটি অধিকার এবং একে সেবা হিসেবে দেওয়া উচিৎ।’

তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা গঠন করা। এই সেবাকে ঝামেলাহীনভাবে দেওয়ার জন্য এ ধরনের সংস্থা আবশ্যক।’

আইইআরের সাবেক পরিচালক ও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর অন্যতম প্রণেতা অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে একটি শিক্ষা আইনের পক্ষে কথা বলে আসছি। এই আইনের অভাবে আমরা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার সংস্কার ও কোচিং সেন্টার নিয়ন্ত্রণসহ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক ইতিবাচক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারিনি।’

তিনি বলেন, ‘শিক্ষকের গুণগত মান, স্কুলের অবকাঠামো, পাঠ্যক্রম, সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম এবং স্কুল পরিচালনার ক্ষেত্রে মালিকদের ভূমিকা সুস্পষ্টভাবে পর্যালোচনা করে এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার করতে হবে।’

এসএইচ-০২/০৪/২২ (শিক্ষা ডেস্ক, সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার)