মেধা তালিকা অনুসারে ভর্তিতে সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে চালু রয়েছে অটোমেশন পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি কলেজে ভর্তির সুযোগ পান শিক্ষার্থীরা। কিন্তু বেসরকারি কলেজগুলোতে মেধায় এগিয়ে থাকলেও এতদিন অনেকেই ভর্তি হতে পারতেন না। কারণ, মেধার চেয়ে টাকাকে বড় ‘মানদণ্ড’ ধরায় অনেকে মেধা তালিকায় এগিয়ে থেকেও ভর্তির সুযোগ পেতেন না। এ অবস্থায় এবার বেসরকারি কলেজেও শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে অটোমেশন পদ্ধতিতে। এ পদ্ধতিকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
অবশ্য ‘টাকার খেলা’ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবার অটোমেশন নিয়ে আপত্তি তুলেছিল বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন। এরই মধ্যে তাদের এ আপত্তির কড়া সমালোচনা করেছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২১ সালে অটোমেশন চালুর উদ্যোগ নেয় সরকার। কিন্তু আপত্তি জানান বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মালিকরা। অটোমেশন পদ্ধতিতে ভর্তির জন্য মালিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা। এতে মালিকরা আরও এক বছর সময় চেয়ে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে চালুর প্রস্তাব দেন। এতে সম্মত হয় সরকার। সে অনুযায়ী এবার সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজেও অটোমেশন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু হচ্ছে। আগামীকাল ৩ জুলাই থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত চলবে ভর্তি প্রক্রিয়া।
কিন্তু ভর্তি শুরুর আগে আবারও আপত্তি তুলেছে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন। নির্ধারিত সময়ের পরও আসন ফাঁকা, পছন্দমতো শিক্ষার্থীরা কলেজ পাবে না বলে তাদের দাবি। এ নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গত ২০ জুন চিঠি দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন।
অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন শিক্ষার্থীরা। সরকারিতে সুযোগ না পাওয়ায় খুলনা সিটি মেডিক্যাল কলেজে মেধা তালিকায় ভর্তির বার্তা পেয়েছেন যশোরের শার্শা উপজেলার ডা. আপিল উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী হাফিজ আল আসাদ। আমাদের সময়কে হাফিজ বলেন, ‘অটোমেশন আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য একটা আশীর্বাদ। কারণ, আমরা সরকারিতে না হলেও বেসরকারিতে যে অনেক টাকা দিয়ে ভর্তি হবো, সে অবস্থা নেই। অটোমেশনের আগে যতই মেধা তালিকায় এগিয়ে থাকুক, ডোনেশন (বাড়তি ফি) ছাড়া কোথাও ভর্তি হতে পারত না শিক্ষার্থীরা। কিন্তু অটোমেশন আসায় সেটার আর সুযোগ নেই।’
হাফিজ বলেন, ‘যত দিন যাচ্ছে, মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। যেসব শিক্ষার্থী বিরোধিতা করছে, তারা ৪০ লাখ টাকা নিয়ে বসে আছে ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু আমাদের অত টাকা নেই। অটোমেশন না হলে আমরা ভর্তিই হতে পারতাম না।’
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন মেহেরপুরের শারমিন সুলতানা শশী। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘অটোমেশন আমাদের জন্য অনেক বেশি উপকারী। আগে নিজেরা যখন আলাদা করে চয়েজ (পছন্দ) দিতাম, তখন বিভিন্ন কলেজে গিয়ে ফরম সংগ্রহ করতে হতো। এতে যাওয়া-আসার কষ্ট ও ভোগান্তির শেষ থাকত না। আর খরচের কথা তো বাদই দিলাম।’
শিক্ষার্থীদের মতো অটোমেশনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন রাজধানীর মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. কাজী জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, ‘যদিও আমি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল, কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে অটোমেশনের পক্ষে। শিক্ষার্থীর পছন্দমতো কলেজে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা থাকলে হবে, যার নেই সে পাবে না। এটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। আগে যেভাবে ভর্তি করা হতো, তা আদর্শ ব্যবস্থা ছিল না। অটোমেশনে শুধু টাকা থাকলেই কেউ ডাক্তার হতে পারবে না, মেধায় এগিয়ে থাকতে হবে।’
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এতদিন একযোগে সারাদেশে মেডিক্যাল কলেজে পরীক্ষা হতো। সরকারিতে ভর্তি শেষ হলে বাকিরা বেসরকারিতে ভর্তির সুযোগ পেত। নিয়ম অনুযায়ী মেধার ভিত্তিতে ভর্তি করার কথা থাকলেও সরকার নির্ধারিত ভর্তি ফির চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ টাকা বেশি নেওয়া হতো।
এ জন্য চলতি বছর বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিতে পরিবর্তন এনেছে সরকার। এতে ছেলেদের জন্য ৬০টি এবং মেয়েরা ৬৬টি কলেজের যে কোনো একটিতে মেধা তালিকা অনুযায়ী ভর্তি হতে পারবে বলে অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়। সে অনুযায়ী বেসরকারির ছয় হাজার ৫০০ আসনে ভর্তির সুযোগ পাবেন শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে মেধা তালিকা অনুযায়ী ক্ষুদে বার্তা দেওয়া হয়েছে শিক্ষার্থীদের। বেসরকারিতে এবার ভর্তি ফি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে উপপরিচালক (সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ) ডা. মুজতাহিদ মুহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘এতদিন বেসরকারি কলেজে সিরিয়াল যত বেশি, ভর্তিতে টাকা তত বেশি লাগত। অটোমেশনের কারণে আর সে সুযোগ থাকছে না। আমরা চাই মেধাবীরা এ পেশায় আসুক।’
তিনি বলেন, ‘ক্যাটাগরির নিচে থাকা কয়েকটি কলেজ আশঙ্কা করছে, তারা শিক্ষার্থী পাবে না, সে রকম কিছু হবে না। প্রয়োজনে আমরা নতুন করে আসন বরাদ্দের বিষয়ে নির্দেশনা দেব।’
এদিকে অটোমেশনে ভর্তির ব্যাপারে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ মালিকরা আপত্তি তুললে গত শনিবার সংবাদ সম্মেলন ডাকে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর। পরে মন্ত্রীর নির্দেশে সেটি বাতিল করা হয় বলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানিয়েছেন, অটোমেশনে ভর্তি এখনো শুরু হয়নি। কিন্তু মালিক সংগঠন কিছু শিক্ষার্থীকে রাস্তায় নামায় অটোমেশন বাতিলের দাবিতে। কিন্তু সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নতুন এই ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। তাই কোনোভাবেই যাতে বিষয়টি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে না যায়, সে জন্য সংবাদ সম্মেলন বাতিল করা হয়। এর পরদিনই অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে মেডিক্যাল কলেজ মালিকরা। এ সময় তাদের আশ^স্ত করা হয়েছে। পরে তারাও সম্মত হন।
বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে অটোমেশন চালুর ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ কে এম আমিরুল মোরশেদ।
তিনি বলেন, ‘অটোমেশন ব্যবস্থা চালুর আগে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মালিকদের সংগঠনের সঙ্গে গত বছর দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। গত বছর থেকে এটি চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। পরে তারা ওই বছর প্রস্তুত নয় জানিয়ে সময় চায়। এবার বিরোধিতার সুযোগ নেই।’
বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার কারণে মালিকরা আপত্তি তুলছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আনোয়ার খান মডার্ন কলেজের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান, যারা ২০ লাখের জায়গায় ৪০ লাখ বা তারও বেশি টাকা নিত, এখন সেই সুযোগ তারা পাবে না। গত বছর ৭০ লাখ টাকায় ভর্তি হওয়ার মতো শিক্ষার্থীও পাওয়া গেছে।’
এদিকে অটোমেশন চালুর আগেই শিক্ষার্থী ভর্তি নিয়েছে রাজশাহীর শাহ মাখদুম ও ঢাকার আশুলিয়ার নাইটিংগেলসহ বেশ কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ। তবে এবার সেই সুযোগ থাকছে না বলে জানা গেছে। অটোমেশনের কারণে সরকার নির্ধারিত কলেজ ছাড়া কোনো শিক্ষার্থীও ভর্তির সুযোগ পাবে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে আমিরুল মোরশেদ বলেন, ‘গত বছর পর্যন্ত রাজশাহীর শাহ মাখদুমসহ কয়েকটি মেডিক্যাল কলেজ নির্দেশনা উপেক্ষা করে শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে। নাইটিংগেলও ছিল সেখানে। এবার অটোমেশন ব্যবস্থাসহ সব সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তাই কোনো কলেজই আর শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারবে না।’
এসএইচ-০৪/০২/২৩ (শিক্ষা ডেস্ক, সূত্র : আমাদের সময়)