আগামী সরকারের কাছে সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজনদের প্রত্যাশা

আগামী সরকারের কাছে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ৩০ ডিসেম্বর। পুরো দেশেই এখন নির্বাচনী হাওয়া বইছে। প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সংশ্লিষ্টরা। চায়ের টেবিলে কিংবা আড্ডায় ঝড় তুলছে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিভিন্ন বিষয়-আশয়।

সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষরাও এই নির্বাচনের দিকে মনোযোগী। কিছুদিন পরই গঠিত হবে নতুন সরকার। এ সরকারের কাছে রয়েছে তাদের নানা প্রত্যাশা।

মিডিয়ায় বিভিন্ন অঙ্গনের কয়েকজন বিশিষ্ট তারকা নিজেদের তথা কর্মসংশ্লিষ্ট সামগ্রিক চাওয়া নিয়ে সরকারের কাছে নিজেদের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন ।

আমি ১৩ বছর বয়স থেকেই সিনেমা অঙ্গনের সঙ্গে আছি এবং কাজ করে যাচ্ছি। তাই সিনেমার সব বিষয়েই আমি ভালোই চাব। যা চলচ্চিত্রের জন্য ভালো সবই চাই।

ছোটবেলা থেকেই এফডিসিতে আমার যাতায়াত। কিন্তু এখন এফডিসিতে গেলে এর দুরাবস্থা দেখে চোখে পানি চলে আসে। যে সরকারই আসুক না কেন চলচ্চিত্রের এ দুর্দশা যেন না থাকে সেটাই আমি প্রত্যাশা করি।

সরকারি অনুদানের বিষয়টায় আরেকটু নজর দেয়া দরকার। কারণ সব কিছুরই খরচ বেড়েছে কিন্তু অনুদানটাও যেন বৃদ্ধি হয়। আকাশ সংস্কৃতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে যেন আমাদের মূল্যবোধের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।

বিশেষ করে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা যেন কোনোভাবেই ঢুকতে না পারে কিংবা আধুনিকতার নামে কোনো খারাপ কিছু যেন চলচ্চিত্রে না আসতে পারে, এ খেয়াল রাখতে হবে সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের।

আধুনিকতার নামে আমরা যেন সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে না যাই সেটির দিকে আরও কড়া নজরদারি করতে হবে সেন্সর বোর্ডকে।

ববিতা, চলচ্চিত্রব্যক্তিত্ব

আমি মনে করি আমাদের বর্তমান সরকার সংস্কৃতিবান্ধব। আমরা সাংস্কৃতিকভাবে এখন ভালো আছি। কারণ যখন এ সরকার ছিল না, তখন আমাদের সংস্কৃতি চর্চার ওপর নানারকম সমস্যা তৈরি হয়েছিল।

নাটকের ওপর একুশে পদকও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। আমি চাইব মঞ্চ নাটক যাতে পেশাজীবিত্ব অর্জন করতে পারে। শিল্প সংস্কৃতি চর্চায় যারা রয়েছেন অর্থাভাবে তারা যেন না মরেন।

এরা সমাজের সবচেয়ে আলোকিত মানুষ। এরাই সমাজকে সমৃদ্ধ করেন। একজন লেখক যেমন সমৃদ্ধ করে, একজন কবি যেমন সমৃদ্ধ করেন, যেমন শেকসপিয়রের নামে ইংল্যান্ডকে চেনে, রবীন্দ্রনাথের নামে ভারতকে চেনে, টলস্টয়ের নামে সমগ্র রাশিয়াকে চেনে। তাই বলব এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা দেশে কাজ করছে তাদের দিকে একটু নজর বেশি দেয়া উচিত।

সমাজের এই সম্মানীয় লোকরা যেন শেষ বয়সে গিয়ে অর্থ কষ্টে না পড়েন, সেই দিকে খেয়াল রাখার প্রত্যাশা করি। শিল্পী, কলাকুশলীদের বাসাবাড়ির ব্যবস্থা করতে পারে সরকার, এ প্রত্যাশাও করি।

আতাউর রহমান, নাট্যব্যক্তিত্ব

আমাদের সময় আগে বিটিভিতে অডিশন দিয়ে পাস করে গান গাওয়ার সিস্টেম ছিল। তবে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোয়ও যেন এ অডিশনের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে ভালো হতো।

বিদেশি বিভিন্ন ট্যুরে যেন ভালো শিল্পী এবং কলাকুশলীরা যায়, এদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের কপিরাইট সিস্টেমটার দিকে আরও মনোযোগ দেয়া দরকার।

যাতে শিল্পীরা তাদের সঠিক মূল্যায়ন পায় এখান থেকে। ভারতে লতা মুঙ্গেশকরকে কপিরাইট নিয়ে ভাবতে হয় না, কিন্তু আমাদের এখানে এখনও সঠিক মূল্যায়ন পায় না শিল্পীরা। এখানে কোনো নিয়মই নেই।

তাই শেষ বয়সে গিয়ে শিল্পীদের জন্য সাহায্য চাইতে হয়। শিল্পীদের সঠিক রয়েলিটি দেয়ার বিষয়টি সরকার নির্ধারণ করে দিলে ভালো হয়। তাহলে আর তাদের সাহায্য চাইতে হবে না।

কারণ শিল্পীরাই কিন্তু মানুষকে বিনোদিত করে, অথচ তারাই বেশি আর্থিক সমস্যায় ভোগেন। শিল্পীদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল চাই সরকারের কাছে। নতুন সরকারে যেই আসুক না কেন আমাদের সমস্যাগুলোর যেন প্রতিকার করেন, এ প্রত্যাশা করি।

ফাহমিদা নবী, সঙ্গীতশিল্পী

মানুষের সবার প্রথম যে চাহিদা সেগুলো হল অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসা। তারপর হচ্ছে বিনোদন। অনেকাংশ সময়েই দেখেছি চাওয়া পাওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকেই একটু নিগৃহীত আমরা।

আমাদের দেশের শিল্পীদের তো অন্য দেশের শিল্পীদের সঙ্গে তুলনা করে লাভ নেই। আমাদের একজন শিল্পী যদি আনন্দ করেও রিকশায় ওঠে, তখন অনেকেই বলেন যে ওই শিল্পীর মনে হয় অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ।

বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে কিন্তু আমাদের বসে থাকতে হয়। যার ফলে একটি শিল্পীর শেষ জীবনে আমাদের কিন্তু কিছুই করার থাকে না। এ ছাড়া আমাদের কিন্তু সেভাবে কোনো কণ্ঠশিল্পী সংস্থা গড়ে ওঠেনি।

যার ফলে আমরা সংগঠিত হতে পারিনি। অনেক বড় শিল্পীর খারাপ সময়ে সাহায্যের জন্য কাজ করতে হয়। শিল্পীদের সৃষ্টিকর্মগুলোর সুবিধা যেন শিল্পীরা পায় এজন্য আইনগতভাবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যদি পায় তাহলে আমাদের শিল্পীরা অনেক বেশি উপকৃত হবে। এতে করে শিল্পীদের শেষ জীবনে আর চিন্তা করতে হবে না।

কুমার বিশ্বজিৎ, সঙ্গীতশিল্পী

আমরা চাই নাটককে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দেয়া হোক। যখন এ ঘোষণাটা আসবে তখন এ শিল্পের সঙ্গে পেশাদার যারা কাজ করছেন তাদের পেশাটা সংরক্ষিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

যখন সরকারের আওতার মধ্যে আসবে তখন এটাকে বজায় রাখা এবং এটাকে যারা বিনষ্ট করছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে এ শিল্পটি আরও এগিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি। আসলে আমরা সুস্থ সুন্দর এবং শিক্ষণীয় বিষয়গুলো সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার ব্রত নিয়ে কাজ করি।

বেশিরভাগ নাট্যশিল্পীরা দিনরাত ভালো পরিশ্রম করছে ভালো কাজের জন্য। কিন্তু কতিপয় লোক লাভের আশায় কাজের পরিবেশ নষ্ট করছে। এতে করে আমাদের প্রায়ই বিব্রত হতে হয়। যার ফলে এর নেতিবাচক বিষয়গুলোর প্রভাব যারা ভালো কাজ করে তাদের ওপরও পড়ে। তবে যাই হোক কিছু নতুন শিল্পী বেশি করে এ অঙ্গনে আসতে হবে।

আর সরকার যদি এ অঙ্গনের দিকে আরেকটু মনোযোগী হয় তাহলে শুধু দেশেই নয় বিদেশেও বেশি করে প্রশংসিত হবে আমাদের শিল্পকর্ম।

আবুল হায়াত, নাট্যব্যক্তিত্ব

নাটক নিয়ে সরকারের চেয়ে নিজেদের লোকদের কাছেই বেশি দাবি আছে। প্রযোজক, চ্যানেল কর্তৃপক্ষ, এজেন্সি, নির্মাতা এদের সবার কাছেই আমার দাবি যে নাট্যজগৎ যেন সুশৃঙ্খল থাকে।

আমি ভিন্ন একটা দাবি করছি সরকারের কাছে। আমি ট্রাফিক জ্যামমুক্ত ঢাকা চাই। প্রতিদিন শুটিংয়ের জন্য শিল্পীরা অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়েন। বিশেষ করে সিনিয়র শিল্পীরা খুব বেশি সমস্যায় পড়েন এ জন্য। কিছুদিন আগে আমি উত্তরা থেকে কলাবাগান গিয়েছি ৩ ঘণ্টায়।

যদি এ যানজট না থাকত তাহলে শিল্পীরা সময়মতো শুটিং স্পটে হাজির হতে পারত। মন ভালো থাকত। সময়মতো কাজ শুরু এবং শেষ করা যেত। এতে করে নাটকগুলোর মানও আরও ভালো হতো। শুধু শিল্পী নয় সাধারণ মানুষও এতে উপকৃত হতো। শিল্পীরাই শিল্পীদের সমস্যা সমাধান করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। তারপর যদি তাও সমস্যা দূর না হয় তাহলে তখন সরকারের কাছে সাহায্য চাওয়া যেতে পারে।

শর্মিলী আহমেদ, নাট্যব্যক্তিত্ব

আরএম-১২/০৬/১২ (বিনোদন ডেস্ক, তথ্যসূত্র: যুগান্তর)