‘দেহ নয়, সুচিত্রা সেনের শক্তি ছিলো অভিনয়’

সুচিত্রা সেনের শক্তি

বাংলাদেশের পাবনায় জন্ম নেয়া রমা কলকাতার সিনেমায় অভিনয় করে সময়ের স্রোতে হয়ে উঠেছেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। তিনি এখন অন্য ভুবনের বাসিন্দা। শত সাধলেও, কাঁদলেও তার দেখা আর মিলবে না কোনোদিন। তিনি হাসবেন না, হুট করে ঘরে ঢুকে যাওয়ায় কাউকে বকবেন না, প্রেমিকের মান ভাঙানো কোনো সংলাপও আর দেবেন না নতুন করে।

বাঙালির হৃদয়ে হাহাকারকে অমরত্ব দিয়ে তিনি চলে গেছেন। তবে রয়ে গেছে তার স্মৃতিরা। তার অভিনীত চলচ্চিত্রেরা। যেখানে এখনো সুচিত্রা পাগল মন শান্তি খুঁজে ফেরে। সাদাকালো যুগে বাংলা সিনেমার পোস্টার গার্ল এই অভিনেত্রীকে নিয়ে এখনো আগ্রহ মানুষের।

টিভিতে সুচিত্রাকে দেখার সুযোগ পেলেই কাজ ফেলে রেখে সেখানে চোখ রাখেন। ইউটিউবে সুচিত্রাকে খুঁজে ফেরে নানা প্রজন্মের পিয়াসী দর্শক মন।

সেই সুচিত্রাকে নিয়ে বই গ্রন্থনা করেছেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও গবেষক আব্দুল্লাহ জেয়াদ। গতকাল ৭ ফেব্রুয়ারি এফডিসির জহির রায়হান কালারল্যাব ভিআইপি প্রজেকশন হলে প্রধান অতিথি হিসেবে ‘কিংবদন্তী নায়িকা সুচিত্রা সেন’ নামের বইটি মোড়ক উন্মোচন করেন প্রখ্যাত অভিনেত্রী সুচন্দা ও অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন।

সেখানে সুচিত্রা সেনকে নিয়ে মজার মজার সব স্মৃতির খাতা খুলে দিয়েছিলেন অতিথিরা। ইলিয়াসি কাঞ্চন বলেন, ‘আমি সুচিত্রা সেনকে কখনো দেখিনি। তার ছবিও তেমন করে দেখা হয়নি। তবে ইউটিউবে তাকে নিয়ে দশ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র দেখেছি।

সেটুকু দেখেই বুঝতে পেরেছি অসাধারণ একজন অভিনেত্রী তিনি। দারুণ মজবুত ছিলো তার অভিনয়। হয়তো বেশি বলা হবে তবুও আমার মনে হয়েছে মহানায়ক উত্তমকুমারের চেয়েও বড় শিল্পী ছিলেন সুচিত্রা সেন। শেষদিকে সিনেমায় নাম দেখানোর সময় সুচিত্রা সেনের নাম আগে আসতো।

এবং বলিউডে গিয়ে দিলীপ কুমারসহ সব নায়কদের সঙ্গে ছবি করে সফল হয়েছেন সুচিত্রা। কিন্তু উত্তমকুমার কিন্তু মুম্বাই গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন।

তবে আমার কষ্টও লেগেছে এই জন্য যে জীবনের শেষদিকে নিজেকে আড়ালে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আমি এটাকে সমর্থন করি না। একজন শিল্পী সারা জীবন যা ইমেজ অর্জন করবে শেষ বয়সে সেই ইমেজ ও সুনামকে মানুষের জন্য কাজে লাগাতে হবে। নইলে শিল্পী হিসেবে তাকে আমি খুব একটা সফল বলবো না।

হয়তো অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন না, তবুও বলছি সুচিত্রা সেনের এই অভিমান কিংবা আড়ালে চলে যাওয়া শিল্পী সত্ত্বার সঙ্গে বেমানান। চিরদিন কেউ একই স্রোতে থাকে না। ভাটা আসেই। কিন্তু এ নিয়ে অভিমান করে দেশ ও সমাজকে বঞ্চিত করা সমর্থনযোগ্য নয়।’

সুচিত্রা সেনকে নিয়ে বলতে গিয়ে অভিনেত্রী সুচন্দা বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। চোখের সামনে থেকে সুচিত্রা সেন ও তার অভিনয় দেখতে পারাকে নিজের সৌভাগ্য বলে মনে করেন তিনি। সুচন্দা বলেন, ‘যখন জহির রায়হান নিখোঁজ হলেন কিছুই ভালো লাগতো না। মন খারাপ করে থাকতাম। চুপচাপ বসে থাকতাম।

তখন কলকাতায় আমার মায়ের খুব কাছের একজন ছিলেন বনানী চৌধুরী। উনি অনেক বড় শিল্পী ছিলেন। আমার মা বেড়াতে কলকাতায় পাঠালেন। তার ওখানে গিয়েও কিছু ভালো লাগে না।

কলকাতায় জহিরের এক বন্ধু ছিলেন খুব ঘনিষ্ট। তিনি একদিন ফোন করে বললেন আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাবেন। আমি যেন রেডি হই। বারবার না করছিলাম। কিন্তু তার জোরাজুরি ও বনানী আন্টির অনুরোধে গেলাম।

বিশাল এক গেট পেরিয়ে একটি বাড়িতে নিয়ে গেলেন। চমৎকার এক বাড়ি। পরিপাটি করে সাজানো চারদিক। পরিষ্কার সোফা। এসব দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি সাদা সিফন শাড়ি পড়া একজন পরীর মতো নারী এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। প্রথমে তো বুঝতে পারছিলাম না। এক সময় মনে হলো আরে এ তো সুচিত্রা সেন।

আমি তো একেবারে অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো স্বপ্ন দেখছি। আমি নিজের গায়ে চিমটি কাটলাম। তিনি ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমাকে বসালেন, তিনিও বসলেন। নাম জিজ্ঞেস করলেন। কথা হলো।

তিনি বলছিলেন, ‘তোমার যদি কখনো খারাপ লাগে, কষ্ট লাগে তুমি এখানে চলে আসবে। তুমি মনে রেখ তোমার একটি দিদি এখানে আছেন। যখন খুশি চলে আসবে। আমি বাংলাদেশে যেতে চাই। যদি কখনো যাই তোমার সঙ্গে দেখা করবো।’

আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই ছিলাম। এতো কথা যেন শুনছিলামই না। মেকাপ ছাড়া সুচিত্রা সেন। একদম সিনেমারই সেই সুচিত্রা। তার সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হয়নি আমার। কিন্তু জহিরের সেই বন্ধু আমাকে অনেকদিন বলেছিলেন যেন একবার কলকাতায় যাই। সুচিত্রা সেন আমাকে রান্না করে খাওয়ানোর দাওয়াত দিয়েছেন। তিনি নাকি আমাকে বড় বড় চোখের বাংলাদেশের মেয়েটা বলে ডাকতেন। তিনি আমাকে মনে রেখেছিলেন, আমার কষ্ট তাকে কষ্ট দিয়েছিলো এটা আমার জন্য সৌভাগ্য। কারণ তাকে দেখে দেখেই নায়িকা হবো বলে স্বপ্ন দেখেছিলাম।

মুক্তিযুদ্ধের পর এখানকার অনেক বড় বড় তারকারাই সুচিত্রা সেনকে দেখার জন্য অনেক চেষ্টা তদবির করেছেন। পাননি। সেদিক থেকে আমি অনেক লাকি যে তার সান্নিধ্য পেয়েছি।’

সুচিত্রার অভিনয় ও জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি বলেন, ‘কী যে এক দুর্দান্ত অভিনেত্রী তিনি ছিলেন তা বর্ণনা করা যায় না। তার একটি ছবির থেকে অন্য ছবিটি আলাদা। তার মুখ, চোখ, চলা, বলা এমনকী দাঁতগুলোও যেন অভিনয় করতো। কোন দৃশ্যে কতটুকু দাঁত দেখানো দরকার, মুখ কতোটা বন্ধ রাখা দরকার সব তিনি মেইনটেইন করতেন।

উত্তমকুমারের সঙ্গে তার জনপ্রিয়তা তো আকাশ ছোঁয়া ছিলো। আমাদের সময় পাইলট পেন নামে নতুন একটি কলম এসেছিলো। সেই কলমের মার্কেট করা হতো ‘পাইলট পেন পাইলট পেন উত্তমকুমারের কোলে সুচিত্রা সেন’ স্লোগান দিয়ে। ভাবা যায়! সেই স্লোগান শোনেই বাবার কাছে বায়না ধরেছিলাম আমাকে পাইলট পেন কিনে দেয়া হয়।

সুচিত্রা সেনের সিনেমার দেখার স্মৃতিগুলোও দারুণ। ওসব বললে শেষ করা যাবে না। প্রিয় অভিনেত্রী তিনি, মহানায়িকা। যেখানেই থাকুন তার আত্মা যেন শান্তিতে থাকে।’

সুচিত্রা সেনের স্মৃতিচারণে কিংবদন্তী পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, ‘আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো সুচিত্রা সেনকে দেখার ও তার সাথে কথা বলার। নব্বই দশকে একটি ছবিতে আমি উনার মেয়ে মুনমুন সেনকে নিয়েছিলাম। সেজন্যই তার বাড়িতে যাওয়া।

তো কাজ শেষে মুনমুনের বাসায় বসে বললাম সুচিত্রা সেনকে দেখতে চাই। শুনেই মুনমুন একেবারে আৎকে উঠলো। বললো, ‘মাফ করবেন দাদা। এটা আমি পারবো না। মা বাইরের কাউকে দেখা দিতে চান না।’ বারবার বলার পর বুদ্ধি দিলো ওর মেয়েরা যখন নানির কাছে যাবে আমি যেন সেই গাড়িতে করে যাই।

সেই মতেই গেলাম। রাইমা আর রিয়া গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গেল বাড়ির ভেতরের দিকে। আমিও ছুটলাম। ওরা দরজায় নক করতেই সেটি খুলে গেল। একজন বৃদ্ধ লোক সেটি খুলে দিলেন। রাইমা ও রিয়া ছুটে গিয়ে একজন মহীলাকে দাদু দাদু বলে জড়িয়ে ধরলো। আমি তাকিয়ে রইলাম বিস্ময়ে। আমার সামনে সুচিত্রা সেন।

তিনিও মুখ তুলে তাকালেন। চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন কে? বললাম বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তার মেয়েকে নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছি। ইচ্ছে ছিলো তাকে একটু দেখার। তাই এলাম। মুচকি হেসে বললেন, ‘আমার মেয়ে অভিনয় করতে পারে?’ উত্তর দিলাম, ‘সে একটু পারে। আর বাকীটা আপনার ইমেজের উপর চালিয়ে নিতে হবে।’ তিনি ইশারা করে বসতে বলে চলে গেলেন। খানিক পর বৃদ্ধ লোকটা চা-মিষ্টি নিয়ে এলো।

সুচিত্রা সেনের দেখা পাওয়াটা ছিলো বাঘের দুধ পাওয়ার মতোই। মুনমুন সেদিন বুদ্ধি করে ওর মেয়েদের সঙ্গে পাঠিয়েছিলো বলে সেই সৌভাগ্য পেয়েছিলাম। তার মতো অভিনেত্রী এই বাংলার আর কখনো আসবে না।’

বরেণ্য চলচ্চিত্রগ্রাহক ও নির্মাতা আব্দুল লতিফ বাচ্চু বলেন, ‘নায়িকা হবার পর সুচিত্রা সেন কখনো বাংলাদেশে আসেননি, বাংলাদেশ নিয়ে কোনো কথাও তিনি বলেননি কোনোদিন। তাকে নিয়ে আমার আলাদা কোনো উচ্ছ্বাস বা গর্ব নেই। তবে অভিনয়ের জায়গায় কথা বলতে গেলে তার মতো কেউ এই উপমহাদেশেই আসেনি বলে মনে করি আমি।

তিনি দেহ দিয়ে নয়, অভিনয় দিয়ে অভিনয় করতেন। তার নায়িকা হবার পেছনে রূপ-সৌন্দর্য হাতিয়ার করতে হয়নি। অভিনয় দিয়ে তিনি মাতিয়ে রাখতেন। দর্শক তার অভিনয়টাই দেখেছে। কোনোদিন তাকে শাড়ির ফাঁকে বাড়তি মনযোগ দিয়ে শরীর দেখাতে হয়নি।

উত্তমকুমারের সঙ্গে তার জুটি দিয়েই মূলত বাংলা সিনেমায় জুটি প্রথার শুরু। তাদের জুটির এতোই জনপ্রিয়তা ছিলো যে কলকাতায় একটি লন্ড্রির দোকান হয়েছিলো যার নাম ছিলো ‘সুচিত্রা লন্ড্রি উত্তম ধোলাই’।’

সুচিত্রার স্মৃতিচারণ করেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার। তিনি বলেন, ‘মুনমুন সেনের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে সুচিত্রা সেনের বাড়িতে যাওয়া হয়েছিলো। তাকে দেখার সুযোগ পাইনি। তবে তার কণ্ঠ শুনেছি। তার হাতে রান্না করা নানা পদের নিরামিষ খেয়েছি।

তিনি এমন একজন মানুষ যাকে দেখার সুযোগ চাইতেন সবাই কিন্তু কেউ মুখ ফুটে বলতে সাহস পেতেন না। কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও তাকে মাত্র একবারই চোখের সামনে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি ভারত সরকারের দেয়া পুরস্কারও আনতে যাননি। তার কাছ থেকে তার গলা শোনা, তার রান্না খাওয়ার অনুভূতি বলে বোঝানোর মতো নয়।’

সাপ্তাহিক বিনোদন ম্যাগাজিন ‘ছায়ালোক’ আয়োজিত এই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রযোজক নেতা খোরশেদ আলম খসরু, পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আব্দুর রহমান প্রমুখ।

বইটি লেখক জেয়াদ উৎসর্গ করেছেন প্রয়াত কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনকে।

আরএম-১৩/০৮/০২ (বিনোদন ডেস্ক)