সিঁদুর-মঙ্গলসূত্র ব্যবহারে সমালোচিত নুসরাত

সিঁদুর-মঙ্গলসূত্র

১৯৯০ সালের ৮ জানুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন নুসরাত জাহান। ওপার বাংলার জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ও মডেল তিনি। তার মাও অভিনেত্রী ছিলেন। গেল লোকসভা নির্বাচনে ভারতীয় পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। সংসদ সদস্য হওয়ার পরপরই বিয়েটা সেরে ফেলেন এই অভিনেত্রী। দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ী বন্ধু নিখিল জৈন নামের এক হিন্দু ধনকুবেরকে বিয়ে করেন তিনি। জন্মসূত্রে মুসলিম হলেও এই অভিনেত্রী বিয়ের পর থেকেই সিঁদুর ও মঙ্গলসূত্র পরতে শুরু করেন। সম্প্রতি সিঁদুর লাগিয়ে ও মঙ্গলসূত্র পরে ভারতের পার্লামেন্টে যাওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়ের তিনি। বিয়ের পর নুসরাতের বেশভূষা নিয়ে ইতোমধ্যেই ‘আপত্তি’ তুলেছেন একজন মৌলবীসহ অনেকেই।

২৯ বছর বয়সী ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি লম্বা নুসরাত ২০১০ সালে ফেয়ার ওয়ান মিস কলকাতা নামক একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হন। পরে সৌন্দর্যগুণে মডেল হিসেবে সুযোগ পান তিনি। এরপর ২০১১ সালে জনপ্রিয় অভিনেতা জিতের বিপরীতে ও রাজ চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘শত্রু’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে পশ্চিম বাংলায় পরিচিতি পান তিনি। ছবিটি এসকে ব্যানারে মুক্তি পায়। সেই থেকে নুসরাতের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

২০১৩ সালে তার ‘খোকা ৪২০’ ও ‘খিলাড়ি’ ছবি দুটি মুক্তি পায়। ২০১৪ সালে মুক্তি পায় ‘অ্যাকশন’, ‘যোদ্ধা: দ্য ওয়ারিয়র’ ও ‘সন্ধ্যে নামার আগে’। ২০১৫ সালে ‘জামাই ৪২০’ ও ‘হর হর ব্যোমকেশ’। ২০১৬ সালে মুক্তি পায় ‘জুলফিকার’ ও ‘লাভ লাভ এক্সপ্রেস’। ‘ওয়ান’ ও ‘বলো দুর্গা মাই কি’ ২০১৭ সালে মুক্তি পায়। ২০১৮-তে ‘নাকাব’ ও চলতি বছর মুক্তি পেয়েছে ‘সেভেন’ ছবিটি। ছবিগুলোর মধ্যে রাজিব বিশ্বাস পরিচালিত ‘খোকা ৪২০’ চলচ্চিত্রটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। ছবিটিতে নুসরাতের বিপরীতে অভিনয় করেছেন, কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেতা দেব। ছিলেন অভিনেত্রী শুভশ্রী গাঙ্গুলীও।

ভিনেত্রী হিসেবে পরিচিতি যখন তুঙ্গে তখনই শোনা গেল ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে নুসরাত উত্তর চব্বিশ পরগনার বসিরহাট আসন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলের হয়ে লড়বেন। রাজনীতির মাঠে নেমেও বাজিমাত করলেন এই অভিনেত্রী। সর্বোচ্চ ভোটের ব্যবধানে জিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পশ্চিমবঙ্গের অনেক আসনে যখন নরেন্দ্র মোদির পক্ষে ভোটবাক্স ভরিয়েছেন ভোটাররা, সেখানে সব হিসাব পেছনে ফেলে তিন লাখ ৫০ হাজার ৩৬৯ ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন নুসরাত। বসিরহাট কলকাতা লাগোয়া এবং মুসলিম–অধ্যুষিত এলাকা। সেখানে চলচ্চিত্রের ইমেজকে সম্বল করে নির্বাচনে জয় পায় মুসলিম পরিবারের মেয়ে নুসরাত।

এদিকে নির্বাচনে জয়ের পরপরই এই অভিনেত্রী বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। বর আর কেউ নন দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ী বন্ধু নিখিল জৈন। চলতি বছরের ১৯ জুন তুরস্কের বোদরুমের ‘সিক্স সেন্সেস কাপালায়াঙ্কা’য় জমকালো বিয়ের আয়োজন করা হয় তাদের। প্রথমবারের মতো টলিউডে তিনিই বলিউডি কায়দায় ‘ডেস্টিনেশন ওয়েডিং’ করেন।

তুরস্কের সমুদ্রের পাড়ের একটি শহর বোদরুম। দর্শনার্থীদের মূল আকর্ষণ বোদরুমের দুর্গ। গভীর পানি পথের নিচে একটি মিউজিয়াম রয়েছে সেখানে। আর সেখানেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। গ্রিক স্থাপত্যে ভরা এই শহরের সাধারণ মানুষের প্রধান পেশা ছিল সাগরে মাছ ধরা। পরে আস্তে আস্তে পর্যটনের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠে এই শহর। নুসরাত ও নিখিল তাদরে বিয়ে ও বাসরের জন্য এমন একটি শহরকেই বেছে নেন।

বিয়েতে ছিলেন দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন আর আরেক টলিউড অভিনেত্রী ও সাংসদ মিমি চক্রবর্তী। মিমিও এবারের নির্বাচনে অংশ নিয়ে নুসরাতের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। মিমি শুধু তার পার্লামেন্ট পার্টনারই নয়, তার সবচেয়ে ভালো বন্ধুও।

বিয়ের আগে নুসরাতের মেহেদি অনুষ্ঠান ও পুল পার্টি অনুষ্ঠিত হয়। বোহেমিয়ান থিমে সাজানো হয়েছিল মেহেদি অনুষ্ঠান। ১৯ জুন বিয়ের দিন নুসরাতের পরনে ছিল লাল লেহেঙ্গা, মাথায় ওড়না, গলায় ভারি স্বর্ণের গয়না, মাথায় টিকলি, হাতে চূড়া ও কালিরাসে সেজে ওঠা নুসরাতকে ঠিক তেমনটাই দেখাচ্ছিল। হেঁটেই বিয়ের মঞ্চে আসেন নুসরাত। চেয়ারে বসে হাত রাখেন তার স্বপ্নের রাজকুমারের হাতে।

তবে শুধু লাল লেহেঙ্গায় সেজে ওঠা ‘ভারতীয় রাজকুমারী’র বেশেই নয়, দুধ সাদা গাউনে নুসরাত হয়ে উঠেছিলেন যেন ভিনদেশের রাজকন্যাও। তার সঙ্গে মিলিয়ে নিখিল জৈনের পরনে ছিল কালো স্যুট। নুসরাত ও নিখিল ‘হোয়াইট ওয়েডিং’র মাধ্যমে একে অপরের জীবনের সঙ্গে এভাবেই জুড়ে গেলেন। ২০ জুন তুরস্কের হোটেল কাপালায়াঙ্কা’য় আয়োজিত হয় ওই ‘হোয়াইট ওয়েডিং ফরমাল’। এ সময় হাঁটু গেড়ে বসে সবাইকে সাক্ষী রেখে আরও একবার প্রেমিকা নুসরাতকে প্রেম নিবেদন করতে দেখা যায় নিখিলকে।

তুরস্কে হিন্দু রীতিতে বিয়ে সেরে নুসরাত দেশে ফেরেন তার স্বামীকে নিয়ে। বিয়ের কারণে এই অভিনেত্রী ১৭ জুন সংসদ শুরুর দিন শপথ নিতে পারেননি। অন্য সাংসদরা অবশ্য এদিন শপথ নেন। পরে ২৫ জুন এমপি হিসেবে শপথ নেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত এই অভিনেত্রী।

বিয়ের পর সাজপোশাকে নিজেকে কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ রাখেননি তিনি। বেগুনি পাড়ের সাদা রঙের শাড়ি, দু’হাতে চূড়া, হাত ভর্তি মেহেদি, গলায় মঙ্গলসূত্র, সিঁথিতে সিঁদুর- এমন বেশে সংসদে শপথ বাক্য পাঠ করেন তৃণমূলের নবাগত এই সাংসদ। মুসলিম নারীর সিঁথিতে সিঁদুর! গলায় মঙ্গলসূত্র! আর এ কারণেই তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন বসিরহাটের এ তৃণমূল সাংসদ।

নুসরাতের বেশভূষা নিয়ে ইতোমধ্যেই ‘আপত্তি’ তুলেছেন দেওবন্দের এক মৌলবী। তবে শুধু এই মৌলবীই নন, সিঁদুর ও মঙ্গলসূত্র পরায় এবার দলেরই একাংশের ‘ক্ষোভ’-এর মুখে পড়েছেন তৃণমূলের এই তারকা সাংসদ। যে বসিরহাট থেকে এবার সাংসদ হয়েছেন নুসরাত, সেখানকারই প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ তথা আইনজীবী ইদ্রিস আলির তোপের মুখে পড়েন নুসরাত।

নুসরাত জাহানের সিঁদুর-বিতর্ক প্রসঙ্গে সাবেক সাংসদ ইদ্রিস আলি জানান, তিনি নিজে কোনো মন্তব্য করেননি। সমালোচনা অন্যজনরা করছেন। শুধু মুসলিম নন, হিন্দুদের অনেকই বলছেন, এটা কী! সে নিজে ঠিক করুক, সে কি মুসলিম? মানুষ বিভ্রান্তি হচ্ছে, সে মুসলিম না জৈন? অনেকে এই প্রশ্ন করছেন।

ইদ্রিস বলেন, ‘আমার মনে হয় ও যা করছে ঠিক নয়। ও একটা অবস্থান ঠিক করুক। মুসলিম হলে মুসলিম ধর্ম মেনে চলতে হবে। হিন্দু হলে হিন্দু ধর্ম মেনে চলতে হবে।’

অন্যদিকে, ভরা সংসদে লোকসভার অধ্যক্ষকে নুসরাতের প্রণাম জানানো নিয়েও আপত্তি তুলেছেন তৃণমূলের ইদ্রিস। এদিকে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে ৪ জুলাই ইস্কনের রথের রশি টানার হ্ন্দু ধর্মীয় রীতি পালন করেছেন বসিরহাটের সাংসদ নুসরাত। তবে এবার রথযাত্রায় নুসরাতের উপস্থিতি নিয়ে মুসলমান নয় প্রশ্ন তুললেন বিজেপি নেতা মুকুল রায়। তৃণমূল কংগ্রেসের এই সাবেক নেতার অভিযোগ, হিন্দুদের ভাবাবেগে আঘাত করেছেন মমতা ব্যানার্জি।

৫ জুলাই এ নিয়ে নিজের যুক্তি দেখান মুকুল। শুক্রবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মুকুল রায় জানান, নুসরাতকে নিয়ে গিয়ে রথের দড়ি টানিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। কারও ধর্মকে আঘাত করতে চান না তিনি। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির কাছে তার একটা প্রশ্ন আছে। মুকুল রায়ের সেই প্রশ্নটি হলো, ‘আমি আমার ধর্মীয় অবস্থানকে না পাল্টে হজে যেতে চাই। মুখ্যমন্ত্রী ব্যবস্থা করুন।’ অর্থাৎ তিনি হিন্দু ধর্মের অনুসারী হয়ে হজ করতে মক্কা যেতে চান, সেটা সম্ভব কি না জিজ্ঞেস করেছেন তিনি।

আসলে জবাবটা তার ভালোই জানা। তবে তিনি বোঝাতে চাইছেন, মুসলমান ঘরের মেয়ে হয়ে হিন্দু ধর্মীয় রীতিনীতি কীভাবে মানছেন নুসরাত জাহান। এক ধর্মের অনুসারী হয়ে অন্য ধর্মের রীতিনীতি পালন করা অনুচিত ও অগ্রহণীয়, এই বিষয়টাই জানান মুকুল রায়।

এদিকে বিতর্ক-সমালোচনা নিয়ে সরব হয়েছেন স্বয়ং নুসরাত জাহানও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নুসরাত জানিয়েছেন, ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের করা মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানালে ঘৃণা ও হিংসা বাড়ে, ইতিহাসেই তার প্রমাণ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি বহুত্ববাদী ভারতের প্রতিনিধি, যা জাতপাত, ধর্মীয় বেড়ার ঊর্ধ্বে। আমি সব ধর্মকেই সম্মান করি। আমি একজন মুসলিম। আমি কী পরবো, তা নিয়ে কেউ মন্তব্য করতে পারেন না। ধর্ম পোশাকের ঊর্ধ্বে।’

দিনকয়েক আগে পার্লামেন্টের বাইরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েও তিনি অনেকটা একই সুরে বলেছিলেন, তিনি লুকিয়ে বিয়ে করেননি, সামাজিকভাবেই বিয়ে করেছেন। তবে বিয়ের পরেও তিনি নিজের ধর্ম অপরিবর্তিত রেখেছেন। নুসরাত এই দাবি করলেও স্পষ্টতই কোনো কোনো মাওলানা তার স্বীকৃতি দিচ্ছেন না।

নুসরাত আরও জানান, জীবনে নেগেটিভিটিকে কখনো গুরুত্ব দেননি তিনি। নুসরতের সিঁদুর ও মঙ্গলসূত্র নিয়ে ইদ্রিস আবারও বলেন, ‘আমরাও দুর্গাপূজার মণ্ডপে যাই, সেখানে তো মুসলিম হয়ে দুর্গাপূজা করি না। মুসলিম হয়ে যদি পাথর পূজা করি, সেটা তো হয় না।’

এদিকে বিজেপির এমপি ও অভিনেত্রী রূপা গাঙ্গুলি নুসরাতের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন, ‘আজকের নিউ ইন্ডিয়া বা নতুন ভারতবর্ষে শুধু দুটোই জাত – একদল প্রগতিশীল, আর অন্যরা শুধু পেছনের দিকে হাঁটছেন।’ যারা নুসরাতের সমালোচনা করছেন সেই দ্বিতীয় জাতটা দ্রুতই কোণঠাসা হয়ে পড়বে বলেও তিনি প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

এই বিতর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘোষণা দিয়েই নুসরাতের পাশে দাঁড়িয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী এমপি ও অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তী।

তুরস্কে হিন্দু রীতি অনুযায়ী বিয়েটা সারলেও ৪ জুলাই, বৃহস্পতিবার রথযাত্রার দিনে রিসেপশন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার এক পাঁচতারকা হোটেলে। করা হয় বিয়ের রেজিস্ট্রেশনও। রিসেপশন অনুষ্ঠানে হোটেলে বসেছিল যেন টলিউডের তারাদের মেলা। উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও তাবড় শিল্পপতিরাও। তবে বহুজনের ভিড়ের মধ্যেও সবার নজর টানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতি। রিসেপশন পার্টিতে এসে তিনি আশীর্বাদ করেন নতুন সাংসদ নুসরাত জাহান এবং তার স্বামী নিখিল জৈনকে।

আরএম-১১/০৬/০৭ (বিনোদন ডেস্ক)