আমার কাজের কোনো মূল্যায়ন হলো না: এটিএম শামসুজ্জামান

আমার কাজের

দেশবরেণ্য অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের জন্মদিন ১০ সেপ্টেম্বর। শুধু অভিনেতা নন, তিনি একাধারে পরিচালক, কাহিনীকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার ও গল্পকার। অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ৫ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। কিংবদন্তী এই মানুষটি বার্ধ্যকের ভারে নুয়ে পড়েছেন। ঠিকমতো কানে শুনতে পান না। দিন কাটাচ্ছেন বাসায় বই পড়ে ও ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে। প্রায় চারমাস হাসপাতালের বিছানায় পার করলেও বর্তমানে তিনি থাকছেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তার মেয়ের বাসায়। তার জীবনের কিছু বিষয় নিয়ে দেশের প্রচলিত অনলাইনে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। হুবহু তা তুলে ধরা হলো-

ষাটের শুরুতে সহকারী পরিচালক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও ক্যারিয়ারে ৫০ বছর পর এসে মাত্র একটি ছবি (ইবাদত) নির্মাণ করলেন! কেন?

এর আগে কেউ আমাকে সুযোগ দেয়নি তাই। একটা ছেলেকে নিয়ে এলো আমার সহকারী। এসে বললো, আমাকে দিয়ে ছবি বানাতে চায়। আমি বললাম, বাবা আমার তো কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। উনি বলেছিলেন, না আপনি পারবেন! তারপর ছবি বানাতে গরিবিয়ানায় এক কোটি টাকা লাগবে বললেও সে রাজি হলো। গল্প শোনাতে চাইলে উনি রাজি হয়নি। তখনই মনে হয়েছিল, কাজটা করা যায়। কারণ প্রযোজক হলো ব্যবসায়ী। গল্পের কী বুঝবে! তখন তাকে বলেছিলাম, ছবি যদি না চলে তাহলে আমাকে কোটি টাকার সমান গালি দিও। তারপর সে-ই আমার ‘ইবাদত’ ছবি প্রডিউস করে। ছেলেটা খুব ভালো ছিল।

তারপর?

ছবিটা ঠিক ঠাকভাবে করে যখন সেন্সরে পাঠাই, আমাদের সম্মানীয় সেন্সর সদস্যরা ওই ছবিটাকে কেটে ছেঁটে একেবারে শুঁটকি বাঁটা করেছিলেন! পরে আমার গল্পটা আমি নিজেই বুঝি নাই। আমার ছবির সঙ্গে আরও ছবি রিলিজ হবে, কোটি টাকা ব্যয় করে ছবি করতে হয়। আমার ছবি যে এডিট করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন অন্য ছবির সঙ্গে রিলিজ দিলে লস হবে। সেন্সরের পর আমি আবার কিছু কেটে ফেলে দেই। তারপরেও আমার ছবিটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে স্থান পায়। যে গল্প আমি বলতে চাই, সেটা যদি না বলতে পারি তাহলে ছবি করে লাভ কী? লোকসানও করবো, আবার মনের তৃপ্তি ও পাবো না, তা তো হয়না।

নতুন করে ছবি বানাতে চাইলে এই সময়ে আপনার কাস্টিংয়ে কারা থাকবে?

নায়ক-নায়িকা বা কাস্টিং নির্ভর করে গল্পের উপর। আমি কোনো স্টারে বিশ্বাস করি না। ছবি হিট হয় তারপর নায়ক-নায়িকা হিট হয়। ছবি ফ্লপ হলে নায়ক-নায়িকার দিকে কেউ ফিরে তাকায় না। এটা ইউজলেস। আর যারা স্টার নির্ভরশীল তারা অধিকাংশই ফ্লপ।

কমেডি, ভিলেন দুই চরিত্রেই দর্শক আপনাকে পছন্দ করেছে। আপনার কমফোর্ট জোন কোনটি?

নায়ক হিসেবেও দুটি ছবি করেছি। দুটোই ছিল সুপারহিট। একটি ছবি ‘দায়ী কে’। আমার গল্পের আমি হিরো, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পাই। অন্যটি, হচ্ছে তারাশঙ্করের ‘চাঁপাডাঙ্গার বউ’। সেখানে সেতাব মণ্ডল চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। সুতরাং কমেডি, ভিলেন ছাড়াও আমি নায়ক হিসেবে সাকসেস পেয়েছি। আমার কাছে সব কাজই আপন। তবে মানুষ আমাকে কেন জানি ‘মন্দ মানুষ’ হিসেবে বেশি চিনেছে!

আপনার ৬০ বছরের ক্যারিয়ার। প্রাপ্তি বহুত, কিন্তু কোনো অপ্রাপ্তি আছে?

১৯৬১ সালে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করি। এর সঙ্গে ছোটখাটো চরিত্রে কাজ করেছি। এখন ২০১৯ সাল। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির শেষ নেই। প্রাপ্তিটা ওই ব্যক্তির ভাগ্যে জোটে যে প্রাপ্তির মর্যাদা দিতে পারে। প্রাপ্তির পর কেউ যদি অন্যকে অপমান করার চেষ্টা করে, তাহলে তার প্রাপ্তির কোনো মূল্য নেই।

অভিনেতা পরিচয় ছাপিয়ে আপনি লেখক। লেখালিখির বিষয় জানতে চাই?

মানুষ যখন কাজের সুযোগ পায় তখন কখনই ভালো মন্দের বিচার করে না। কাজটা করতে হবে এই চিন্তা করে। যাদের জন্য কাজ করলাম তারা পছন্দ করলো কিনা একজন প্রগতিশীল মানুষের এটাই প্রথম স্বপ্ন। মানুষ যদি বলে কাজটা ভালো হয়েছে, তাহলে উৎসাহ জাগে আরও কাজ করবো। অথচ আমার কাজের কোনো মূল্যয়ন হলো না। আমার ৫২টি গল্প বাংলাদেশ আর্কাইভে জমা আছে। আজকে যে দেশের খুনাখুনি, মারামারি হচ্ছে এই গল্প আমি প্রথম লিখেছিলাম অ্যাডভান্স চিন্তা থেকে। গল্পের নাম ছিল ‘সীমার’। গল্পগুলো আর্কাইভে পড়ে আছে। তাহলে আমার লেখালেখিকে মূল্য়ায়ন করা হলো?

আপনি প্রচুর বই পড়েন। অসুস্থ হওয়ার পর ওই অভ্যাসটা আছে?

ক্লাস সেভেনে যখন পড়ি, তখন থেকেই বই পড়ি। দস্যু মোহনের দুইশ সিরিজের বই প্রথম পড়ি। ফাল্গুনি মুখোপাধ্যায়, ব্যোমকেশ, নেহাল গুপ্ত এসব ছোট থেকেই পড়া শুরু করেছি। এখন বাসায় সারাদিন ইবাদত করি, আর বই পড়ি।

শুনেছি, আপনি হজ করেছেন অনেকবার?

আমি মোট ১১ বার হজ করেছি। সাতবার ওমরা এবং ৪ বার ফরজ।

শেষবার কবে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখেছেন?

আমার ঠিক মনে নেই শেষ কবে গিয়েছি। তবে হলের পরিবেশ খুব খারাপ হয়েছে। যদি হলের পরিবেশ ভালো হয়, তবে যাবো। আমার কাছে বলাকা সিনেমা হল ভালো লাগে। বসুন্ধরায় (স্টার সিনেপ্লেক্স) ছবি দেখতে গেলে মানুষ অল্প হলেও এর দর্শক বেশি ভদ্র। ওইখানে আমাকে নিয়ে গেলে বলবে আমি ‘খারাপ লোক’।

আপনার সময়ে যারা কাজ করতেন, তাদের মধ্যে নায়ক-নায়িকা হিসেবে কাদের ভালো লাগতো?

আমার সময়ে রাজ্জাককে খুব ভালো লাগতো। নায়িকা হিসেবে যাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছি তিনি কবরী। এরপর শাবানা। সে খুব সিনসিয়ার ছিল। এই সিনসিয়ারিটি তাকে অনেকদূর নিয়ে গেছে।

ভিলেন হিসেবে আপনি কেমন ছিলেন?

ভিলেন হিসেবে আমি ছিলাম অতি নিম্নমানের। আমার এক্সপ্রেশন এতো বাজে ছিল সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। পয়সা পেয়েছি। এই ছাড়া আর লাভের কিছু পাইনি। মনের মতো ভিলেন চরিত্র আমার করা হয়নি।

ভিলেন হিসেবে দর্শকদের কাছ থেকে বিড়মন্বনায় পড়েছেন?

রাস্তায় বের হলেই ‘বদ লোক’ যাচ্ছে কতবার যে একথা শুনেছি তার ঠিক নেই। একবার এক গ্রামে শুটিং করতে গেছি। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। ওই গ্রামের এক বউ পানি ভর্তি কলস নিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে ‘খচ্চর’ বলে চিৎকার করে কলস রেখে দৌড়ে পালায়।

এখনকার সময়ে আপনার কাছে পছন্দের নায়ক-নায়িকা কারা?

শাকিব খান। ও দেখতে অনেক সুন্দর। এরপর অমিত হাসানও ভালো। দেখতে সুন্দর হলেই নায়িকা হয়না। নায়িকা হতে হয় অভিনয় গুণে। বাংলাদেশ প্রথম যাকে আমি নায়িকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি সে হলো মৌসুমি। সে সত্যিই অভিনয় করতে পারে। তারপর শাবনূরের মধ্যে আমি সেই সম্ভাবনা দেখেছি। শুনেছি, এখন আর আগের মতো কাজ করে না সে।

চলচ্চিত্রের সুদিন দেখতে পান?

আমি হতাশ নই। ভীষণভাবে আমি আশাবাদী। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত আমি আশাবাদী থেকে যাবো। সবাই বলে ফিল্মের অবস্থা খারাপ। কিন্তু আমি বলবো, অপেক্ষা করো। খারাপ চিরদিন খারাপ থাকবে না। হতাশ হইও না। অবশ্যই ভালো দিন আসবে।

আরএম-১৪/১০/০৯ (বিনোদন ডেস্ক, তথ্যসূত্র: চ্যানেল আই অনলাইন)