হলিউড থেকে পিছিয়ে ছিলেন না আমাদের নির্মাতারাও

হলিউড থেকে

৫ নভেম্বর ১৯৬৫ সালে মুক্তি পায় ‘রূপবান’। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা ও প্রযোজনা করেন সালাউদ্দিন। সেই সময় এর নির্মাণ ব্যয় ছিল ১ দশমিক ৫০ লাখ রুপি। অসম্ভব ব্যবসাসফল হয় চলচ্চিত্রটি।

অগ্রসর লোকের পাশাপাশি এ সিনেমার কল্যাণে প্রেক্ষাগৃহে আসতে শুরু করে গ্রামের অশিক্ষিত ও নিম্ন আয়ের মানুষজনও। আমার দুঃখ হতো যখন দেখতাম একদল তথাকথিত আধুনিক লোক এই সিনেমাকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে।

আমার দুঃখ গলে গর্বে ভরে গেল দুই যুগ আগে যেদিন দেখলাম হলিউডের ছবি ‘দ্য সাউন্ড অব মিউজিক’। রবার্ট ওয়াইজ প্রযোজিত ও পরিচালিত সিনেমাটি মুক্তি পায় ২ মার্চ ১৯৬৫ সালে।

হলিউডে সিনেমাটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৮ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার এবং এটি আয় করেছিল ২৮৬ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলার।

আমাদের ‘রূপবান’-এর আয়ের হিসাব না জানা গেলেও ‘রূপবান’ যে খরচের তুলনায় অনেক বেশি আয় করেছিল, তাতে কারও দ্বিমত নেই। আমি আমাদের ‘রূপবান’ -এর সঙ্গে হলিউডের ‘দ্য সাউন্ড অব মিউজিক’ সিনেমার তুলনা করতে চাই না। দুটি ছবির গল্প সম্পূর্ণ আলাদা।

আমাদের ‘রূপবান’ -এর কাহিনি প্রচলিত লোককাহিনি আর ‘দ্য সাউন্ড অব মিউজিক’-এর গল্প এক বিপত্নীক জেনারেল, তার সন্তান ও গভর্ন্যাসকে নিয়ে। দুটি সিনেমাই সংগীতনির্ভর ‘মিউজিক্যাল ফিল্ম’।

আমার আনন্দ ও গর্বের জায়গা হলো ইউটিউব, ইন্টারনেট, মোবাইল প্রযুক্তির যখন জন্ম হয়নি, দেশে কম্পিউটার ও টেলিভিশনের যখন প্রচলন হয়নি সেই সময় আমাদের এফডিসির নির্মাতারা চিন্তাচেতনা এবং সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে গল্প নির্বাচনে হলিউড থেকে পিছিয়ে ছিলেন না। মন চাইলেই সব করা যায় না তা দুটি ছবির নির্মাণ ব্যয় দেখলেই বোঝা যায়।

এফডিসির নির্মাতারা যে পিছিয়ে ছিলেন না, তার একটি প্রমাণ পেলাম বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক এখন কানাডা প্রবাসী ড. ফরিদ আহমেদের ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে।

তিনি লিখেছেন, “রংবাজ মুক্তি পাওয়ার পরের বছরই মুক্তি পায় জিঘাংসা নামের একটি চলচ্চিত্র। এর পরিচালক ছিলেন ইবনে মিজান। এ চলচ্চিত্রটা একটা বিদেশী উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে করা। যে উপন্যাসটার ছায়া অবলম্বনে করা হয়েছিল, সেটার নাম হচ্ছে ‘দ্য ব্রাইড অর ব্লাক’।

এটি লিখেছিলেন উইলিয়াম আইরিশ নামে একজন লেখক। উপন্যাসে দেখা যায় একজন প্রতিশোধপরায়ণ নারীকে। এই নারীর স্বামীকে বিয়ের দিনেই মেরে ফেলেছিল পাঁচজন ঘাতক। বিধবা হওয়ার পর কারও পোশাক পরে স্বামীর ঘাতকদের খুঁজে খুঁজে বের করে একে একে হত্যা করেন তিনি। এ উপন্যাসটি নিয়ে ফ্রান্সেও একটি ফিল্ম তৈরি হয়েছিল ১৯৬৮ সালে।”

এফডিসি থেকে জিঘাংসা মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। ফোক ছবির জন্য পরিচিতি পেলেও বিশ্বসাহিত্য ও চলচ্চিত্রের খোঁজ রাখতেন এফডিসির ইবনে মিজানরা। আমার গর্ব হয়, যখন ভাবি এই এফডিসিতেই সুভাষ দত্ত নির্মিত ‘সুতরাং’ সিনেমা ১৯৬৫ সালে ফ্রাংকফুর্ট চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার লাভ করে; মস্কো চলচ্চিত্র উৎসব (১৯৬৭, ১৯৭৩ ও ১৯৭৯) এবং নমপেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (১৯৬৮) পুরস্কৃত হয়।

এফডিসি আমার মনে ভীষণভাবে নাড়া দিল যেদিন জানলাম ১৯৫৯ সালের ৮ মে মুক্তিপ্রাপ্ত উর্দু চলচ্চিত্র এখানেই নির্মিত। ‘জাগো হুয়া সাভেরা’র সহকারী পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। এ চলচ্চিত্রের অন্যতম অভিনেতা খাঁন আতাউর রহমান। ছবিটি জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের দর্শকদের দেখতে দেয়নি।

আইয়ুব খানের ভয় ছিল এই সিনেমা দেখলে জনগণ কমিউনিজমে ঝুঁকে যাবে। আহ! সিনেমার কি যে ক্ষমতা। লন্ডনে ছবিটি মুক্তি পায়। সরকারের নির্দেশ অমান্য করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং তার স্ত্রী প্রথম প্রদর্শনের দিন দেখতে যান। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয় এ ছবিটি। মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ সেই সময় মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে।

আরএম-০৬/০৭/১১ (বিনোদন ডেস্ক, তথ্যসূত্র: দৈনিক আমাদের সময়)