প্রধানমন্ত্রীও আমাকে রূপবান বলে ডাকেন : সুজাতা

প্রধানমন্ত্রীও

নীরবে নিভৃতে জীবন কাটানো এক রঙিন মানুষ সুজাতা। ১৯৬৫ সালের ‘রূপবান’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করেছিলেন তিনি। ষাট দশক থেকেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে আসছেন ঢাকাই সিনেমায়। তবে অনেকদিন ধরেই অভিনয় থেকে বাইরে তিনি। চলচ্চিত্র বিষয়ক কিছু অনুষ্ঠানে হঠাৎ দেখা মেলে তার।

বাংলা চলচ্চিত্রের এই গুণি অভিনেত্রীকে এবার আজীবন সম্মাননা দিচ্ছে সরকার। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পাচ্ছেন তিনি। সেই প্রাপ্তির অনুভূতি জানতে তার মুখোমুখি হয়েছিলো গণমাধ্যমের সাথে।

ব্যক্তি জীবন ও সিনেমার নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তুলে ধরা হলো আলাপের চুম্বক অংশ।

প্রশ্ন : এবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আজীবন সম্মাননা পেতে যাচ্ছেন, কেমন লাগছে?

সুজাতা : পুরস্কারটি একটু দেরিতেই পেলাম। তবুও আমি খুব খুশি। রাষ্ট্র আমাকে এতো বড় সম্মান দিচ্ছে , আমি কৃতজ্ঞ। পুরস্কার পেলে আসলেই ভালো লাগে। কোনো শিল্পী কিন্তু পুরস্কার পাওয়ার জন্য কাজ করেন না। আমিও সারাজীবন কাজ করে গেছি দেশের মানুষের জন্য।

তারা অনেক ভালোবাসাও দিয়েছেন আমাকে। নতুন প্রজন্মের জন্য কী করে যেতে পারছি এটাই সবসময় আমাকে ভাবিয়েছে। এখনো কিছু না কিছু করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

তবু রাষ্ট্রের কাছ থেকে আজীবন সম্মাননা পাওয়া জীবনের বড় একটা প্রাপ্তি। একটা তৃপ্তি দেয় মনের মধ্যে। মনে হয় যে কিছুটা হলেও কিছু করতে পেরেছি।

প্রশ্ন : সামনে কী নতুন কোনো সিনেমায় অভিনয় করছেন?

সুজাতা : এখন তো সিনেমার তেমন কাজ নাই। আর বয়সও বেড়েছে, হাতে কাজ কম থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এ নিয়ে আমার কোনো রাগ-দুঃখ নাই। এখন সিনেমাতে মা-বাবার চরিত্রও কম রাখা হয়। সিনেমা যারা বানায় তারা নায়ক-নায়িকাদের টাকা দিয়েই হয় তো কুলাতে পারেন না।

প্রশ্ন : এখনকার সিনেমা নিয়ে আপনার ভাবনা কী?

সুজাতা : আমি মনে করি মা-বাবা, দাদি, বড় বোন না থাকলে পারিবারিক সিনেমার গল্প ঠিক জমে ওঠে না। এই চরিত্রগুলো সিনেমায় থাকা উচিৎ। আগে আমরা যখন সিনেমা করেছি তখন পারিবারিক গল্পকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। মা-বাবা, ভাই-বোন, ভাবি,দাদা-দাদি, খালা এই চরিত্রগুলো সিনেমায় বিশেষ গুরুত্ব পেতো। নায়ক-নায়িকার প্রেমগুলো তাদের ঘিরেই আবর্তিত হতো। তাদের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে সমাজ গঠনের নানা ম্যাসেজ দেওয়া হতো।

এটা কিন্তু আজকালকের ছবির মধ্যে পাওয়া যায় না। এখন মনে হয় সিনেমায় নায়ক-নায়িকার প্রেম ছাড়া আর কিছুই বুঝি নেই। যারা একটু ভিন্ন ধরনের ছবি বানাচ্ছেন তারাও একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এগুচ্ছেন। সেখানেও দুই একটা চরিত্রকেই প্রাধান্য দেয়া হয়।

প্রশ্ন : এখন গল্প উপস্থাপনের ধরণও অনেক বদলেছে-

সুজাতা : গল্প বলার ধরণ বদলাতেই পারে। কিন্তু গল্প ভালো না হলে বদলে তো লাভ নাই। আমার মনে হয়, সিনেমা-নাটকে বড়দের চরিত্রগুলো রাখা প্রয়োজন। তাহলে গল্পের গতিটা সুন্দর হবে। দর্শক পছন্দ করবে। শুধু নায়ক আর নায়িকা দিয়ে তো একটা বড় গল্প উপস্থাপন করা যায় না। অভিজ্ঞতার একটা মূল্য যেমন আছে এর একটা শৈল্পিক সৌন্দর্যও কিন্তু আছে। আগের পরিচালকরা সেটা বুঝতেন। তারা বয়স হয়ে যাওয়া শিল্পীদের দিয়েও শিল্পকে প্রকাশ করতে জানতেন। রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন, সাইফুদ্দিনের মতো শিল্পীরা তার প্রমাণ।

প্রশ্ন : একটুখানি পুরোনো দিনে ফিরে যাই। আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আলোচিত সিনেমা ‘রূপবান’। সিনেমাটির কোনো না বলা স্মৃতি শোনাবেন?

সুজাতা : ‘রূপবান’ আমার জীবনের সেরা সাফল্য বলতে পারেন। লোকগ গল্পের এই সিনেমা মানুষকে এতোটাই মুগ্ধ করেছিলো যে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেছিলো এই ছবি। গ্রাম থেকে শহর-বন্দরে ছড়িয়ে পড়েছিলো রূপবানের নাম। একদম প্রবাদের মতো হয়ে গেছে।

আজও কাউকে একটু দেখতে ভালো লাগলে তাকে রূপবান বলে ডাকা হয়। এটা কিন্তু বিরাট বড় সাফল্য একটি সিনেমার জন্য, একজন পরিচালক বা শিল্পীর জন্য। আমার গর্ব হয় রূপবান নিয়ে। এই ছবির কথা এখনো মানুষ ভোলেনি।

ছবিটি রচনা ও পরিচালনা করেছেন সালাউদ্দিন। এই সিনেমাটি ছিলো ভাষা আন্দোলনের একটা অঙ্গ। পুর্ব পাকিস্তানে তখন উর্দূ ছবি নির্মাণ হতো। উর্দূ সিনেমার বাজার অনেক বড় ছিলো। তখন কেউ বাংলা সিনেমা নির্মাণ করতে চাইতো না।

বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন আমাদের সালাম, শফিক বরকতেরা। ভাষা নিয়ে অনেক কথা হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্রে কারো আগ্রহ নেই। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ বলে যে ভাষার জন্য লড়াই করেছি সে ভাষা রেখে তাহলে কেনো উর্দূ সিনেমা নির্মাণ করছি! সালাউদ্দিন সাহেব, আমার প্রয়াত স্বামী অভিনেতা ও প্রযোজক আজিমসহ কয়েকজন মিলে আমরা এটা ভাবলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলা ভাষার সিনেমার। তারই ধারাবাহিকতায় লোকগাঁথার গল্প নিয়ে ‘রূপবান’ সিনেমাটি নির্মাণ করা হলো।

প্রশ্ন : রূপবান ছবিটি দর্শক কেন এতো পছন্দ করেছে বলে আপনার মনে হয়?

সুজাতা : বাঙালি গল্প শুনতে ভালোবাসে। রূপকথা ভালোবাসে। এখানে গল্প ছিলো। রূপকথাও ছিলো। সেকারণেই ছবিটা দর্শক গ্রহণ করেছে।

যারা জানে তারা বলেন, ‘রূপবান’ একটা ভাষা আন্দোলনের ছবি। একটা মেয়ের দৃড়তার ছবি, একজন স্বামী ভক্ত মেয়ের ছবি। ১৯৬৫ সালে পূর্বপাকিস্তানে গ্রামে-গঞ্জে এই ছবিটা চলেছে। গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়িতে চড়ে মানুষ সিনেমা হলে ছবি দেখতে এসেছে। এর আগে মেয়েরা তেমন ছবি দেখতে আসতো না। মা-বোনেরা দল বেঁধে এই ছবি দেখেছে। এটা একটা বিপ্লবও। আমাদের সিনেমার বিপ্লব।

প্রশ্ন : এখনও ‘রূপবান’ ছবির মূল্য অনেক বেশি। আপনি কী মনে করেন?

সুজাতা : আমি যেখানে যাই সেখানেই আমাকে ‘রূপবান’ বলে ডাকা হয়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আমাকে রূপবান বলে ডাকেন। কী যে ভালো লাগে! সিনেমায় অভিনয় করে অনেক সম্মান আমি পেয়েছি। এখনো পেয়ে যাচ্ছি। এর বেশিরভাগই এই রূপবানের জন্য।

প্রশ্ন : সবশেষে আপনার বর্তমান ব্যস্ততা নিয়ে জানতে চাই….

সুজাতা : গত বছর একুশে বইমেলায় একটি বই লিখেছিলাম। বইটির নাম ‘শিমুলির ৭১’। আসছে বইমেলার জন্যও লিখছি। ‘রূপকথা’ ও ‘ওয়ারিশ’ নামে দু’টি বই লিখছি। তাছাড়া আমার আত্মজীবনী লেখার কাজও চলছে। লেখালেখি নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটছে আমার।

আরএম-০৮/১২/১১ (বিনোদন ডেস্ক, তথ্যসূত্র: জাগোনিউজ)