করোনা–আতঙ্কে প্রবাসের বাংলাদেশি তারকারাও

করোনা–আতঙ্কে

করোনাভাইরাস তছনছ করে দিয়েছে সারা বিশ্বের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। পাল্টে দিয়েছে জীবনের স্বাভাবিক গতিপথ। কী হচ্ছে, কেউই যেন কিছু বুঝতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি তারকারাও আতঙ্কের মধ্যে সময় পার করছেন। তবে রাষ্ট্রের দেওয়া সতর্কতা অক্ষরে অক্ষরে মেনেও চলছেন।

প্রবাসে থাকা তারকারা নিজেদের নিয়ে চিন্তিত হওয়ার পাশাপাশি দেশের আত্মীয়-পরিজন ও সহকর্মীদের নিয়ে ভীষণ টেনশনে আছেন। কদিন আগেও তাঁরা কর্মস্থলে যেতেন, আড্ডায় মেতে থাকতেন, সন্তান নিয়ে স্কুলে যাওয়া–আসা করতেন—এখন তাঁরা ঘরে বসে দিন পার করছেন। কেউ আবার খাদ্যসংকটের কথা চিন্তা করে এক–দুই মাসের সদাইপাতিও করে রেখেছেন। সংকট কত দিন পর্যন্ত গড়ায়, তা–ও কেউ বুঝতে পারছেন না।

দেশের বাইরে থাকা প্রতিটি শিল্পীর এলাকা লকডাউন করে দেওয়ায় গৃহবন্দী জীবনে ঢুকে গেছেন তাঁরা। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, কানাডায় থাকা বাংলাদেশি তারকাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘরটাই এখন তাঁদের সবকিছু। পরিবার নিয়ে তাঁরা সময়টা কাটাচ্ছেন।

নিরাপদ ও উন্নত জীবন, উচ্চশিক্ষা, নিজেকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে দেশের বিনোদন অঙ্গনের কেউ প্রবাসজীবন বেছে নিয়েছেন। কেউবা পরের প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে রুপালি জগতের চূড়ায় থাকা ক্যারিয়ার ছেড়ে চলে যান দেশের বাইরে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে থাকা এসব তারকার এখন মন ভালো নেই। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেশে থাকা আত্মীয়–পরিজনদের চিন্তায় অনেকের ঘুম উধাও।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে দেড় যুগের বেশি সময় ধরে পরিবার নিয়ে থাকেন শাবানা। দীর্ঘ সময়ে এমন পরিস্থিতি কখনোই দেখা হয়নি তাঁর। আট দিন ধরে ঘর থেকেই বের হন না তাঁর পরিবারের কেউ। সোমবার রাতে দেশের চলচ্চিত্রের একসময়ের বরেণ্য এই অভিনয়শিল্পী বললেন, ‘আমাদের এখানে গভর্নমেন্ট সবকিছু লকডাউন করে দিয়েছে। সবাইকে ঘরে থাকতে অনুরোধ করেছে। ছেলেমেয়ে ও তাঁদের সন্তান নিয়েই কেটে যাচ্ছে।’ শাবানার স্বামী নিউ জার্সিতে আবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। করোনার প্রভাবে অন্য সবকিছুর মতো এই ব্যবসায়ও ধস নেমেছে। তিনিও এখন পুরোপুরি ঘরে সময় কাটাচ্ছেন।

জ্যাকসন হাইটসে থাকা সংগীতশিল্পী বেবী নাজনীন দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ছেলেকে নিয়ে ঘরবন্দী হয়ে কাটাচ্ছেন। নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডে থাকেন টনি ডায়েস। তাঁর একমাত্র মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। করোনার কারণে মেয়ের ছুটি। বাসায় বসে ক্লাস চলছে। স্ত্রী নৃত্যশিল্পী প্রিয়া ডায়েসও দুই সপ্তাহ ধরে ঘরে বন্দী। টনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী প্রিয়া কাজকর্ম বন্ধ করে ঘরে। মেয়েরও বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি। আমার টুকটাক কাজে বাইরে যেতে হচ্ছে। তবে সাবধানতা অবলম্বন করছি। কী যে হতে যাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে সাবধানতা অবলম্বন করে থাকতে হবে এটুকু জেনে গেছি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নির্দেশনা মেনে চলছি।’

টনি ডায়েস বলেন, ‘সারা পৃথিবী এই মুহূর্তে একটা বড় দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই একটা যুদ্ধে লিপ্ত। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাই আমরা কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস নামক অজানা শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছি, যে শত্রুকে আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। যাকে দেখার জন্য অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে বসাতে হয়। আমরা আমাদের নিজের অজান্তে আমাদের শরীরে নিয়ে আসছি আমাদের কিছু খামখেয়ালিপনার জন্য।’

গত অক্টোবরে কন্যাসন্তানের মা হন রোমানা। নিউইয়র্কের জ্যামাইকাতে থাকা রোমানা জানালেন, ‘এখানকার অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে। তিন সপ্তাহ ধরে ঘরে বন্দী আমরা। শুনেছি, এখানকার অনেক বাঙালির শরীরে করোনা ধরা পড়েছে। আমাদের এলাকার অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। তবে বাংলাদেশে থাকা পরিচিতজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে।’

কানাডার মন্ট্রিয়লে মেয়ে ওয়ারিশকে নিয়ে থাকেন একসময়ের আলোচিত মডেল ও অভিনয়শিল্পী তিন্নী। জানালেন, ‘মেয়ের স্কুল বন্ধ। এখন ঘরে বসেই কাটছে সময়। কিছুই করার নেই। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরাখবর পড়ে করোনার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি। নিয়ম মেনে চলছি।’

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে থাকেন মডেল ও অভিনয়শিল্পী মোনালিসা। তিনি জানালেন, ‘সবকিছুই লকডাউন। আমিও বাসায়।’ প্রমিথিউস ব্যান্ডের সদস্য বিপ্লবও এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বাসিন্দা। সেখানকার একটি হাসপাতালের সঙ্গে তাঁর ব্যবসা আছে। রোববার রাতে তিনি বলেন, ‘সরকারি একটি হাসপাতালের সঙ্গে আমার কাজ। তাই এই সময়টায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিয়ে বের হতে হচ্ছে। তবে সবকিছু কেমন যেন থমকে গেছে। এমনটা সত্যি খুবই ভয়ংকর; যা কেউ হয়তো কল্পনা করতে পারেনি। আমার সন্তানেরা ঘরে, কেউ বের হচ্ছে না। পড়াশোনা করে, আড্ডা দিয়ে সময় কাটাচ্ছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় মা, স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে থাকেন ইমন সাহা। সেখানকার ফুল সেল ইউনিভার্সিটিতে সংগীতের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এই সংগীত পরিচালক। তিনি বললেন, ‘প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছি না। পাশের দুই শহরে কারফিউ চলছে। তবে আমার শহরটা খোলা। ক্যাম্পাস বন্ধ। অনলাইনে ক্লাস করছি। তবে আমার সন্তানের স্কুল পুরোপুরি বন্ধ।’

আরেক সংগীত পরিচালক ফুয়াদ আল মুক্তাদিরও সপরিবার যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তিনি বললেন, ‘মানসিকভাবে যন্ত্রণা বেশি।’ নাটক ও বিজ্ঞাপনচিত্রে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন ইপ্সিতা শবনম শ্রাবন্তী। এখন দুই সন্তান নিয়ে নিউইয়র্কের কুইন্সে থাকেন শ্রাবন্তী। বললেন, ‘বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ। ১০ দিন ধরে ঘর থেকে বের হই না। সবকিছু কেমন যেন থমকে গেছে। দুই মেয়েকে নিয়ে ঘরে বন্দী জীবন কাটছে। কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতেছি না। পৃথিবী নামের সাজানো–গোছানো বাগান কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। সবাইকে সৃষ্টিকর্তা নিরাপদে রাখুক, এই দোয়া করছি।’

নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা অভিনয়শিল্পী রিচি সোলায়মানের স্বামী রাশেক মালিক। পরিবারের মধ্যে তিনি ছাড়া বাকি সবাই আট দিন ধরে গৃহবন্দী সময় কাটাচ্ছেন। মঙ্গলবার দুপুরে নিউইয়র্ক থেকে রিচি বলেন, ‘এখানে অবস্থা খুবই খারাপ। সবার কাছে দোয়া চাই। রাশেককে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। তবে দুই সন্তান সঙ্গে থাকায় সময়টা কেটে যাচ্ছে। তবে ওদের বাবার জন্য খুব চিন্তা হয়, কিছু তো করারও নেই, পাবলিক সার্ভেন্ট। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ থাকায় ওরা বাড়ির পেছনে খেলাধুলা করে সময় কাটিয়ে দেয়।’

পরিবারের সবাইকে নিয়ে শাবনূর অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থাকেন। বাংলাদেশের অনেক আগে করোনা সেখানে সংক্রমিত হয়েছে। সন্তানের স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। শাবনূর বললেন, ‘কোনো কাজ ছাড়া আমরা ঘরের বাইরে যাচ্ছি না। বাজার করে রেখেছি। বুঝতে পারছি না কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। এখানে তো সুযোগ–সুবিধা আছে, কিন্তু বাংলাদেশে তো এমনটা নেই। দেশের বন্ধুদের জন্য তাই টেনশনটা বেশি।’

২০০৫ সালে আশা ভোসলের গাওয়া গানটি নতুন করে গেয়ে সবার নজর কাড়েন নির্ঝর। গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দিলেও ওই সময় পড়াশোনার জন্য লন্ডন চলে যান তিনি। ইস্ট লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ এবং অক্সফোর্ড ব্রুকস থেকে এসিসিএ শেষ করে ২০১০ সালে দেশে ফিরে আবারও গানে নিয়মিত হওয়ার চেষ্টা করেন। দেশে ফেরার পর ‘জানি একদিন’ ও ‘আজকের এই নিশি’ গানগুলো নির্ঝরকে আলোচনায় নিয়ে আসে। সেই নির্ঝর এখন আছেন প্যারিসে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রকল্পে সংগীত শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। করোনায় সেখানে সব কাজ থেমে গেছে। সোমবার রাতে প্রথম আলোকে এই সংগীতশিল্পী জানালেন, ১৯ মার্চ থেকে তিনি লকডাউন অবস্থায় আছেন। ৩১ তারিখ পর্যন্ত এভাবে কাটবে। যেখানে কাজ করতেন, এক মাসের ছুটি ঘোষণা করেছে। পরিস্থিতির ওপর বিবেচনা করে সময় বাড়তেও পারে। তবে আজ পরিস্থিতি কিছুটা ভালো বলে শুনলাম। আমি ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছি। নিজেকে এবং আশপাশের সবাইকে ভালো রাখতে আমাদের এই কয়েকটা দিন ঘরে থাকতেই হবে। তবে জরুরি কোনো প্রয়োজনে যদি আমাদের বের হতেই হয়, তাহলে অনুমতিপত্র সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। তবে দেশে থাকা মা-বাবা আর হবু স্বামীসহ সবার জন্য মনটা ভীষণ খারাপ। সবাইকে আল্লাহ হেফাজত করুন।’

এর বাইরে আশিকুজ্জামান টুলু, ফারজানা রিয়া, মিলা হোসেন, নাফিজা, আমব্রিন, সোনিয়া, অগ্নিলা, শশী প্রমুখ দেশের বাইরে আছেন। তাঁদের সবাই করোনাভাইরাসের আতঙ্কে কেউ এক সপ্তাহ কেউবা দুই সপ্তাহ ধরে অবরুদ্ধ জীবন যাপন করছেন।

আরএম-১৫/২৫/০৩ (বিনোদন ডেস্ক, তথ্যসূত্র: প্রথম আলো)