করোনার প্রভাবে বদলে যাবে হলিউড

দুনিয়াজুড়ে সিনেমা হলগুলো বন্ধ পড়ে আছে। বন্ধ হয়ে গেছে চলচ্চিত্র, নাটক, থিয়েটারসহ বিনোদন জগতের সব ধরনের কার্যক্রম। বড় হাউজগুলো নতুন ব্যবসায়িক মডেল নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। ডিজিটাল প্লাটফর্ম আরো বিকশিত হচ্ছে; শিল্পীরাও বলছেন, ‘আপনাকে মানিয়ে নিতে হবে।’

হু স্যামুয়েল তার বান্ধবীকে লন্ডনের এক প্রেক্ষাগৃহে ‘দি ইনভিজিবল ম্যান’ ছবিটি দেখাতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে তাদের সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তেই মানুষের জীবনে এমনটা ঘটেছে কয়েক মাসে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো যুক্তরাজ্যের সিনেমা চেইন মার্চের মধ্যভাগে এসে বন্ধ হয়ে গেছে। স্যামুয়েল কী করেছিলেন? তিনি এক মগ চা নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের আলো নিভিয়ে অ্যামাজন প্রাইমে ১৬ পাউন্ড খরচ করে ইনভিজিবল ম্যান দেখেন। স্যামুয়েল নিজেও অভিনয় ও পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত। মহামারীর কারণে তার কয়েকটি বিজ্ঞাপন ও ফিচারের কাজ আটকে গেছে। তার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন এমন—‘করোনার কারণে আমি সিনেমা হলে যেতে পারছি না… কিন্তু এটা স্ট্রিমিংয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আমার চোখ খুলে দিয়েছে।’

করোনার সংকট শুরু হওয়ার আগে থেকেই দর্শকদের হলবিমুখতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছিল বড় স্টুডিও ও হল মালিকদের মধ্যে। এরপর এই করোনাভাইরাস স্ট্রিমিং বাণিজ্যের ধারণাকে বিরাট এক সাফল্য এনে দিয়েছে। হলিউডে ডিজিটাল মাধ্যমকে ব্যবহার নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে।

অ্যামাজন স্টুডিওর সাবেক হেড অব স্ট্র্যাটেজি ম্যাথু বল বলেছেন, ‘কভিড-১৯ ডিজিটাল বিপণন ও ব্যবসায়িক মডেলকে জনপ্রিয় করে তুলবে। সিনেমা হল, পার্কগুলো ব্যবসা হারাবে, ফুলেফেঁপে উঠবে গেমিং কোম্পানিগুলো।’

ইউনিভার্সাল ইনভিজিবল ম্যান থিয়েটারে মুক্তি দিয়েছে ২৮ ফেব্রুয়ারি। ২১ দিনের মাথায় তারা হলে ছবিটির প্রদর্শনী সীমিত করে আনে। ২০ মার্চ তারা ছবিটি অনলাইনে ১৯ দশমিক ৯৯ ডলারে ভাড়া দেয়া শুরু করে। ইনভিজিবল ম্যান নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে ছবিটি বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য করেছে ১২৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলারের। তবে প্রায় ২০ ডলারের রেট কতটা কার্যকর হবে, সেটা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ব্লামহাউজের সিইও জেসন ব্লাম। তিনি বলেছেন, নেটফ্লিক্স যেখানে মাসে ১২ ডলারের সাবস্ক্রিপশনে অনেকগুলো ছবি দেখাচ্ছে, সেখানে ২০ ডলারে একটি ছবি দেখাটা কঠিন।

ইউনিভার্সালের পদ্ধতিটি শিগগিরই অন্যরা অনুসরণ করেছে—ডিজনি, সনি ও ওয়ার্নার ব্রস। তবে এরা ছবি বিক্রি করছে, ইউনিভার্সালের মতো ভাড়া দিচ্ছে না। প্যরামাউন্ট এপ্রিলে তাদের রোমান্টিক কমেডি ‘দ্য লাভবার্ডস’কে পাঠাবে নেটফ্লিক্সে। কথা হচ্ছে এসব পরিবর্তন আপাতত করোনাভাইরাসের মহামারীকে মোকাবেলা করতে গিয়ে হচ্ছে। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে, এ সংকট কেটে গেলে অনেক দিন এসব প্রক্রিয়া ঘুরেফিরে অব্যাহত থাকবে। নতুন নতুন ছবি যদি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে হলে না গিয়ে ঘরে বসেই দেখা যায়, তাহলে কতজন দর্শক আর হলে যেতে চাইবেন? সেটা করোনাভাইরাস চলে গেলেও।

হলিউড এখন কোয়ারেন্টিনে। ছবি ও টেলিভিশন প্রডাকশন একেবারে বন্ধ। এর মধ্যে কিছু প্রধান সেক্টর কাজ করার নতুন নতুন উপায় খুঁজে বের করছে। টেলিভিশনগুলো লেট নাইট টেলিভিশন শো প্রচার করছে। হোস্টদের বাড়িতেই এসব অনুষ্ঠানের চিত্রগ্রহণ করা হচ্ছে। চিত্রনাট্যনির্ভর অনুষ্ঠানে লেখক যুক্ত হচ্ছেন ভিডিও কনফারেন্সে।

হলিউডে সম্ভাব্য ক্ষেত্রে এমনিতেই ঘরে বসে কাজ করার প্রচলন শুরু হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি এই রীতিকে আরো বেগবান করবে। এরই মধ্যে ছবির সম্পাদনা ও ভিজুয়াল ইফেক্টের মতো কাজগুলো ঘরে বসেই করছেন সংশ্লিষ্টদের অনেকে। আর এ প্রক্রিয়ায় ছোট স্টুডিওগুলো কিছু কাজ পাচ্ছে। যেমন এস্তোনিয়ার একটি ছোট স্টুডিও ইমেপিল্টে কাজ করেন ৩০ জন কর্মী। এ অ্যানিমেশন স্টুডিওটি ডিজনিরা মুলানের চিত্রনাট্যকারের লেখা একটি ফিচারে কাজ করছে। ইমেপিল্টের সিইও আলমোন্ডি এসকো বলেছেন, ‘অল্প পরিশ্রম আর কিছুটা সৃষ্টিশীলতা থাকলেই একটা অ্যানিমেশন কোনো ঝামেলা ছাড়াই শেষ করা যায়। আপনার লেখক, প্রযোজক লস অ্যাঞ্জেলেসে, সেলস এজেন্ট যুক্তরাজ্যে আর আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নিউইয়র্কে—আপনার শুধু দরকার হবে এমন একটা ব্যবস্থা, যা প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে বিভিন্ন মহাদেশ ও টাইমজোন থেকে। যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ব্যবস্থা চালিয়ে নেয়া যাচ্ছে, সেগুলোর প্রতি ধন্যবাদ জানাই। আমার মনে হয়, গত কয়েক সপ্তাহের অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলাই যায় যে এ পরিস্থিতি আমাদের প্রডাকশন পাইপলাইনকে তিন গুণ দক্ষ করে তুলেছে।’

ট্যালেন্ট অ্যান্ড ব্র্যান্ডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যাডাম শোয়েটজার বলেছেন, ‘আপনি মাঝে মাঝে এমন সব কাজ করতে বাধ্য হবেন, যেগুলো নিয়মিত কাজ নয়। দিন শেষে এমন কাজে অর্থ সাশ্রয় হয়, কিন্তু ফল হয় আগের মতোই; তখন মানুষ বলতে শুরু করে, ‘ওহ, আগে কেন এমনটা করিনি?’

শিল্পীরাও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছেন। ক্রিস মার্টিন কিংবা জন লিজেন্ডের মতো তারকারা ঘরে বসে ভক্তদের জন্য লাইভ কনসার্ট করছেন। ডিজে ডি-নাইস ইনস্টাগ্রামে লাইভ পার্টি করছেন।

ব্লাম বিশ্বাস করেন, করোনাভাইরাসের মহামারী সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রাখবে কনটেন্টের ওপর। ‘সব শিল্পীই এ মহামারী দিয়ে প্রভাবিত হয়েছেন। তাই গল্প বলাটা অবশ্যই বদলে যাবে। এটা আপনি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্রে ভালোভাবে দেখতে পাবেন।’