কিশোর কুমার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন

বেঁচে থাকলে আজ ৯৩ পূর্ণ করে ৯৪ বছরে পা রাখতেন প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী কিশোর কুমার। ১৯২৯ সালে মধ্যপ্রদেশের খান্দোয়ায় আইনজীবী কুঞ্জলাল গঙ্গোপাধ্যায় ও গৃহিণী গৌরী দেবীর ঘরে জন্ম হয় কিশোরের। তার জন্মনাম ছিলো আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায়।

ব্যাতিক্রমী ও অনন্য কণ্ঠের এই গায়ক-অভিনেতা তার ৫৮ বছরের জীবনে জয় করে নিয়েছিলেন অগণিত শ্রোতা-দর্শকের হৃদয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ক্যারিয়ারের স্বর্ণসময়ে নিষিদ্ধ হতে হয়েছিল কিশোরকে। তার জন্মদিনে ফিরে দেখা যাক সেই ঘটনার আদ্যপান্ত।

ভারতে তখন জরুরি অবস্থা জারি করেছে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার। সংবিধান স্থগিত, রাজনৈতিক কার্যক্রম সীমিত। সে সময় যুব কংগ্রেসের একটি পদযাত্রায় কিশোরকে গান গাইতে অনুরোধ করেন ইন্দিরা পুত্র সঞ্জয় গান্ধী। কিন্তু কিশোরের মন তাতে সায় দিলো না।

তিনি ভাবলেন, একজন শিল্পী হিসেবে এভাবে একটি দলের পরিচয় বহন করা ঠিক হবে না। তাই অনুপস্থিত থাকলেন। এতে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ একটু অবাক হলেও তখনো ব্যাপারটি গুরুতর হয়ে ওঠেনি।

যুব কংগ্রেসের পদযাত্রায় তো কিশোর হাঁটলেন না। এরপর তার কাছে এলো তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বিদ্যা চরণ শুক্লা সে সময় কংগ্রেসের পক্ষে ২০ দফা কর্মসূচি নিয়ে প্রচারণা শুরু করেন। এই দফাগুলো এসেছিল মূলত সঞ্জয় গান্ধীর মাথা থেকে। বলিউড তখন সাধারণ জনতার হৃদয়ের মণিকোঠায়। সে সময়ের শীর্ষ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে তাই এই কর্মসূচি উপলক্ষে নির্মিতব্য বিজ্ঞাপনচিত্রের গানটি গাইবার প্রস্তাব পান কিশোর।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সে সময়কার যুগ্মসচিব সি বি জৈন কিশোর কুমারকে টেলিফোন করে তার বাড়িতে একদল সচিবসমেত আসতে চান। কিশোর গানটি গাইতে চান না বলে ফোন রেখে দেন।

কিশোরের এই প্রত্যাখানের খবর চলে যায় মুখ্য সচিব এস এম এইচ বার্নির কাছে। বার্নি বিদ্যা চরণ শুক্লার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন। এরপরই কিশোর কুমারকে রাষ্ট্রীয় সব গণমাধ্যম থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। সে সময় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বলতে ছিলো দূরদর্শন ও আকাশবাণী। দুটি মাধ্যম থেকেই নিষিদ্ধ হওয়ায় ব্রডকাস্টিং মিডিয়া থেকে পুরোপুরি আড়াল হয়ে যান কিশোর। তাকে চলচ্চিত্রের প্লেব্যাকে নিতেও বাধা দেয়া হয় প্রযোজক ও সঙ্গীত পরিচালকদের। তার গ্রামোফোন রেকর্ড বাজার থেকে অলিখিত নিষেধাজ্ঞায় তুলে নেওয়া হতে থাকে।

কিশোরকে নিষিদ্ধ করার ফলে অনেক প্রযোজকই আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। তারা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য কংগ্রেসকে চাপ দিতে থাকেন। তবে তাতে কাজ হয়নি।

সাংবাদিক রঞ্জন দাশগুপ্তর সাথে আলাপচারিতায় মান্না দে বলেছিলেন, ‘রফি (মোহাম্মদ রফি) সঞ্জয় গান্ধীর সঙ্গে সরাসরি দেখা করে বলেছিল যে, জওহরলাল নেহরুর নাতি হয়ে আপনি কী করে কিশোরের মত শিল্পীকে নিষিদ্ধ করতে পারলেন?’

এদিকে, ১৯৭৭ সালের ২০ জানুয়ারি প্যারোলে মুক্তির ৫ দিন পর নাট্যকর্মী, নির্দেশক ও অ্যাক্টিভিস্ট স্নেহলতা রেড্ডির মৃত্যু হয়। তিনি নিজেও জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে আন্দোলনে জড়িত ছিলেন এবং কারাগারে অমানুষিক নির্যাতনের স্বীকার হন।

এই মৃত্যুর পর দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ তৈরি হয়। সত্যজিৎ রায় জওহরলাল নেহরুর ওপর তথ্যচিত্র বানাতে অস্বীকার করেন। দেব আনন্দ ও তার ২ ভাই (চেতন ও বিজয়), উৎপল দত্ত, মনোজ কুমার, প্রাণ, উত্তম কুমার, হৃষিকেশ মুখার্জি, সলিল চৌধুরীসহ অনেকেই প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।

পরবর্তীতে কংগ্রেস জরুরি অবস্থা বাতিল করে ও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভরাডুবির মধ্য দিয়ে তাদের একটানা ৩০ বছরের শাসনের অবসান হয়। এরপর কিশোর কুমারের ওপর আরোপিত সমস্ত নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করা হয়।

পরবর্তীতে জনতা দলের মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হলে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। জাস্টিস জে সি শাহের নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিশনের কাছে বিদ্যা চরণ শুক্লা স্বীকার করেছিলেন—এসব মূলত তার ও সঞ্জয়ের ইচ্ছাতেই ঘটেছিল। এটি একজন শিল্পীর প্রতি অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায্য আচরণ বলে তিনি একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

১৯৭৭ সালে এই নিষেধাজ্ঞা ওঠার পর আবার দূরদর্শনে দেখা যায় দুরন্ত পারফরমার কিশোরকে, আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত হয় তার গান। পরবর্তীতে প্লেব্যাকে-কনসার্টে শীর্ষে ছিলেন আমৃত্যু।

এসএইচ-০৩/০৪/২২ (বিনোদন ডেস্ক)