একজন কিংবদন্তির গল্প

এক সমুদ্র ভালোবাসার পরও যার অন্যের প্রতি থাকে ঝোঁক, সে আমার না হোক। কাউকে ভালোবাসার অনেক পথ আছে, কিন্তু তাকে ভোলার কোনো পথ নেই! প্রেমে পড়ার সঙ্গে রঙ্গিন প্রজাপতির উড়ে বেড়ানোকে মিলিয়েছিলেন তিনি। ভালোবাসা নিয়ে এমনই উপলব্ধি ছিল মহাতারকা হুমায়ূন ফরীদির। তার অনুভূতি ছিল এতটাই শ্বাশত, যে তার বলে যাওয়া উক্তিগুলো এখনও অমর হয়ে আছে মানুষের মুখে। তার অভিনয়, জীবনবোধ তাকে কিংবদন্তি অভিনেতায় পরিণত করেছে।

রক্তে মিশে ছিল অভিনয়, নাট্য জগতের সবাই বুঝেছিল এক ধূমকেতুর পা পড়েছে এ অঙ্গনে। একদিন নিশ্চয়ই পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে শাসন করবে এই যুবক। করেছিলেনও তাই। সেদিনের হিসাব যে একেবারেই সঠিক ছিল সেই প্রমাণ টানা তিন দশক তার ম্যাজিকাল অভিনয়ে বুঁদ করে রেখেছিলেন অভিনয় প্রিয় পুরো বাঙালি জাতিকে। যেকোনো চরিত্র ফুটিয়ে তোলার কারিগর ছিলেন। কখনো গরিবের বেশে আবার কখনও উচ্চবিত্তের বেশে, কখনো রিকশাচালক কিংবা ভিলেন। হয়তো চোর নয়তো পুলিশ! সব চরিত্রেই তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন।

পানি যেমন যে পাত্রে রাখা হয় সেই পাত্রের আকার ধারণ করে, হুমায়ূন ফরীদিও ছিলেন ঠিক সে ধরনের একজন অভিনেতা। যখন যে চরিত্রে অভিনয় করতে বলা হতো সেই চরিত্রটাকেই নিজের মতো করে অভিনয় করে ফুটিয়ে তুলতেন। তাইতো আজও তার কাজগুলো এ যুগের তরুণ অভিনয় শিল্পীদের কাছে অনুকরণীয়। তার অভিনয়ে ছিল এমনই এক অনন্য জাদু যে সেই সাদাকালো টেলিভিশনের যুগ থেকে এখন পর্যন্ত সব দর্শক অপলক তাকিয়ে থাকে।

একজন হুমায়ূন ফরীদি বারবার জন্মায় না। তার মত শিল্পী জন্মাতে যুগ যুগ সময় লাগে, শতাধিক বছর লাগে। একজন প্রকৃত অভিনেতা মনে হয় তিনিই যিনি মঞ্চ, নাটক, সিনেমা- সব জায়গাতেই দক্ষতার সাথে অভিনয় করতে পারেন আর মানুষের মন জয় করতে পারেন। কানকাটা রমজান থেকে নব্বই দশকের একের পর এক ব্যবসাসফল বাণিজ্যিক সিনেমা- সব জায়গাতেই ফরীদির জয়জয়কার। দহন, একাত্তরের যীশুর মতো ভিন্ন ধরনের সিনেমাতেও তিনি নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এ ছাড়াও সন্ত্রাস, লড়াকু, দিনমজুর, বীর পুরুষ, বিশ্ব প্রেমিকের মতো সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি।

ব্যক্তিগত জীবনে হুমায়ূন ফরীদি দুইবার বিয়ে করেছিলেন। স্বাধীনতার পরপর রমনা পার্কে প্রথম স্ত্রী মিনুর সাথে বেলী ফুলের মালা বদল করে বিয়ে করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তফাকে তিনি বিয়ে করলেও ২০০৮ সালে তাদের বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে।

‘মাতৃত্ব’ সিনেমার জন্য ২০০৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছিলেন হুমায়ূন ফরীদি। এ ছাড়া নৃত্যকলা ও অভিনয় শিল্পের জন্য ২০১৮ সালে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেছিলেন এই অভিনেতা।

নতুন ও প্রতিষ্ঠিত বহু অভিনয় শিল্পী, হুমায়ূন ফরীরির মতো হতে চান। ফরীদি যেমন মানুষের হৃদয়ে দীর্ঘ ছাপ রেখে গেছেন, তেমনি তারাও চান এক একজন হুমায়ূন ফরীদি হতে। এক অনন্য অনুপ্রেরণার নাম আজও তিনি হুমায়ূন ফরীদি।

বলেছিলেন তিনি, মৃত্যুর মতো এতো স্নিগ্ধ, এতো গভীর, সুন্দর আর কিছু নেই, কারণ মৃত্যু অনিবার্য। তুমি যখন জন্মেছো তখন তোমাকে মরতেই হবে। মৃত্যুর বিষয়টি মাথায় থাকলে কেউ পাপ করবে না। যেটা অনিবার্য তাকে ভালোবাসাটাই শ্রেয়। মৃত্যুকে ভয় পাওয়াটা মূর্খতা। জ্ঞানীরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করো-গ্রহণ করো, বরণ করে নাও।

২০১২ সালের বসন্তের প্রথম দিনে হঠাৎ তার জীবনের সব রঙ এ মর্তলোকে রেখে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এরপর থেকে হুমায়ূন ফরীদির শহরে নিয়ম করে বসন্ত নামে। সেই বসন্তের আগমনে শহরের চারদিকে রঙের ছড়াছড়ি হয়। শুধুই থাকেন না একজন হুমায়ূন ফরীদি।

এসএইচ-১১/০৮/২২ (বিনোদন ডেস্ক)