জাকিরের প্রেম-প্রতারণায় ‘২৮৬’ নারী

জাকিরের প্রেম

‘আমি মসজিদ ছুঁয়ে শপথ করছি, তোমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাব না। তোমাকে ছাড়া আমার জীবন বৃথা, তোমাকে না পেলে আমি এখনই আত্মহত্যা করব’—এসব কোনো সিনেমায় নায়িকার উদ্দেশে দেওয়া নায়কের ডায়ালগ নয়; বাস্তব জীবনে ‘২৮৬ নারীর’ সর্বনাশকারী জাকির হোসেন বেপারি নামের এক ব্যক্তির মিষ্টি বাক্য।

জাকির হোসেন বেপারির গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলায়। শুধু মিষ্টি মিষ্টি কথার মোহে ভুলিয়ে এই ব্যক্তি অনেক নারীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে প্রথমে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন, এরপর তাদের বিয়ের নাম করে ধর্ষণ করতেন। তার প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া এমন কয়েকজন নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

নায়কের মতো সুদর্শন চেহারার অধিকারী হওয়ায় খুব সহজেই নাকি জাকির এসব কথা বলে সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিত ও চাকরিজীবী নারীদের প্রেমের ফাঁদে ফেলতেন। অবশ্য তার প্রেমে পড়া অধিকাংশ নারীর দাবি, এই ব্যক্তি নাকি কোনো সম্মহোনী শক্তি বা ম্যাজিক জানতেন, যার ফলে তার ছুড়ে দেওয়া প্রেমের আবেদন কোনো নারীই প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন না। ফলে অধিকাংশ নারীই তার সাথে সারা জীবন কাটাতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেন। কিন্তু সেই বিয়ের প্রক্রিয়াটা ছিল পুরোটাই ভুয়া। অর্থাৎ, বিয়েতে কাজি, মৌলভি, বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই উপস্থিত থাকতেন। তবে তারা কেউই আসল নন।

ভুয়া বিয়ের পরে সুদর্শন জাকির মাত্র অল্প কয়েক দিন পরই বউদের কাছ থেকে কৌশলে নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার ও অন্য মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে কেটে পড়তেন। আর সবকিছু হাতিয়ে নেওয়ার পরেও শান্তিতে থাকতে দিতেন না প্রতারণার শিকার নারীদের। বিয়ের পরে তোলা নিজেদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ওই নারীদের কাছ থেকে আরও টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিতেন তিনি।

প্রতারণার শিকার নারীদের ভাষ্য, জাকির এ পর্যন্ত ২৮৬ জন নারীর সর্বনাশ করেছেন। আর তারা সবাই উচ্চ শিক্ষিত। কারণ জাকিরের মূল টার্গেটেই ছিল সমাজের প্রতিষ্ঠিত নারীরা।

জাকির সর্বশেষ গত ৮ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়া এলাকার এক নারীর সঙ্গে প্রতারণা করতে গিয়ে ধরা পড়েন। তাকে আটকের পরে ওই নারীর মাধ্যমে যোগাযোগ করে প্রতারণার শিকার আরও চার নারী মিলে জাকিরকে প্রকাশ্যে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করেছেন। এরপর ওই দিনই এক নারীর দায়ের করা ধর্ষণ মামলায় জাকিরকে গ্রেফতার করে মিরপুর মডেল থানা পুলিশ।

চাকরি চাইতে গিয়ে সর্বনাশ

জাকিরের প্রতারণার শিকার টাঙ্গাইলের ভুয়াপুরের এক নারী বলেন, ‘আমার জানা মতে আমার আগে পুষ্প (ছদ্মনাম) নামের এক মেয়ের সাথেও একই ধরনের প্রতারণা করেছে জাকির। গত বছরের এপ্রিল মাসে আমি একটা গ্রুপের কল্যাণ অফিসার হিসেবে চাকরি করতাম। সেখানে এক লোকের মাধ্যমে খবর পাই যে একটা বড় ফ্যাক্টরিতে লোক নেওয়া হবে। সেই ব্যক্তি আমাকে জাকিরের কাছে পাঠান। জাকির তখন নিজেকে ওই কোম্পানির জিএম পরিচয় দেন। আমি তার কাছে আমার সিভিটা জমা দিয়ে আসি। এরপর থেকে জাকির বিভিন্নভাবে আমার সাথে যোগাযোগ করত। তার সাথে ওই পরিচয়ের সূত্র ধরেই আমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর সম্পর্কের মাত্র এক মাস পরেই স্থানীয় এক কাজির মাধ্যমে আমাদের বিয়ে হয়। এখন পর্যন্ত তার সাথে আমার বিবাহ বিচ্ছেদ হয় নাই।’

ওই নারী আরও বলেন, ‘উনি (জাকির) আমাকে বলেছিল তার নাকি হাউস লোন আছে। তারা টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে, এই বলে আমার কাছ থেকে দফায় দফায় পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছে। এরপর আরও পাঁচ লাখ টাকা চেয়েছিল। কিন্তু সেটা দিতে পারি নাই বলেই তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার কাছ থেকে সে প্রায় এক বছর আগে চলে গেছে। আমি তাকে বলেছিলাম আমি তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াব। তখন সে আমাকে বলে, ‘‘আমার কিছুই করতে পারবি না, আমি কাঁচা খেলোয়াড় না। এ পর্যন্ত তোর মতো ২৮৬টা মেয়ের সাথে এ রকম হয়েছে’’।’

জাকিরের চক্রের বর্ণনা দিয়ে ওই নারী আরও বলেন, ‘জাকির বলত তার বাবা-মা কেউ নেই। তাই তার বাড়িতে কেউই নেই। তিনি কোনোদিন বাড়িতেও যান না। তার এই কাজের সাথে সে একা নয়। তার একটা বড় চক্র আছে, যারা সবাই একসাথে কাজ করে। এক মেয়ে আমার সাথে ভিডিও কলে কথা বলত জাকিরের বোন পরিচয় দিয়ে। এখন শুনি সে নাকি জাকিরের বউ। আবার বাদল নামের একজন ওর ভাই পরিচয় দিয়ে আমার সাথে অনেকবার কথা বলেছে। এখন জানতে পারছি সে নাকি জাকিরের চক্রের বস। জাকির আমার সাথে তাদের ভাই ও বোন হিসেবে পরিচয় করে দিয়েছিল। সব মেয়ের সাথে একই পদ্ধতি ব্যবহার করেছে।’

আমি আমার পরিবারকে এত দিন বোঝাতে পারিনি যে আমি কীভাবে প্রতারিত হয়েছি। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে। আমার পরিবার আমার পাশে আছে, তাই আমি জাকিরের বিরুদ্ধে খুব শিগগির আইনি ব্যবস্থা নিব।’

ভুয়া বিয়ে

জাকিরের প্রতারণার শিকার রাজধানীর উত্তরা এলাকায় বসবাসকারী এক নারী জানান, তিনি উত্তরা এলাকার একটি ভালো প্রতিষ্ঠানে বড় পদে চাকরি করতেন। একই এলাকায় চলাফেরা করার সুবাদে রাস্তায় মাঝেমধ্যে জাকিরের সাথে তার দেখা হতো। এরপর ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের দিকে জাকির একদিন তার কাছে গিয়ে মোবাইল নাম্বার চেয়ে নেন। জাকির তখন নিজেকে একটি বড় প্রতিষ্ঠানের জিএম হিসেবে পরিচয় দেন। মোবাইলে কথা বলার সুবাদে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক।

ওই তরুণী বলেন, ‘কিছুদিন পরেই জাকির আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ওই সময়ে আমার বাবা-মা হজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তাই আমি তখন বিয়ে করতে রাজি হইনি। হঠাৎ জাকির একদিন আমাকে ডেকে উত্তরা এলাকার একটি মসজিদের সামনে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে সে মসজিদের দেয়াল ছুঁয়ে আমাকে বলে, ‘‘আমি মসজিদ ছুঁয়ে শপথ করছি তোমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাব না, তোমাকে ছাড়া আমার জীবন বৃথা, তোমাকে না পেলে আমি এখনই আত্মহত্যা করব’।” তার এমন আকুতি শুনে আমি বিয়েতে রাজি হয়ে যাই। সেই দিনই সে একটি প্রাইভেট কারে আমাকে নিয়ে গাজীপুরের কোনো একটি এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে এক বাসায় তার সাথে আমার বিয়ে পড়ানো হয়। ওই বাসায় আগে থেকেই কাজি রেডি করা ছিল। আর সাক্ষী হিসেবে একজন নারী ও একজন পুরুষ ছিল। জাকির তাদের সহকর্মী বলে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।’

প্রতারণার বর্ণনা দিয়ে ওই তরুণী বলেন, ‘আমার প্রথম খটকা লাগে। জাকির বিয়ের পরেই আমার কাছে ওই বাসাতে টাকা চায়। সে আমাকে বলে যে তার কার্ড ব্লক হয়ে গেছে তাই সে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারছে না। আমি তখন আমার কাছ থাকা ১১ হাজার টাকা তাকে দেই। সে আমার টাকা নিয়ে ওই কাজিকে টাকা দিয়ে দেয়। পরে জানতে পারি ওই কাজি ছিল ভুয়া। আর সাক্ষীদেরও কোনো সন্ধান নেই।’

বিয়ের পরের কয়েক মাসে জাকির ওই তরুণীর কাছ থেকে নানা অজুহাতে প্রায় তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নেন এবং সর্বশেষ তার দুটি মোবাইল ও একটি ল্যাপটপ নিয়ে জাকির চম্পট দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন ওই তরুণী।

নারী পটানোর জাদু জানেন জাকির?

ভুক্তভোগী কয়েকজন নারীর সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তারা সবাই উচ্চ শিক্ষিত ও ভালো চাকরিজীবী। তবে সবাই কীভাবে এমন প্রতারণার শিকার হলেন, জানতে চাইলে সবার উত্তর প্রায় একই রকমের ছিল যে, ‘জাকির নিশ্চয় মেয়ে পটানোর জন্য বিশেষ কৌশল বা কোনো জাদুমন্ত্র অথবা অন্য কিছু একটা জানত।’

ভুক্তভোগী এক তরুণী বলেন, ‘আমরা যতগুলো মেয়ে তার মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছি, খোঁজ নিয়ে দেখুন প্রতিটা মেয়েই উচ্চ শিক্ষিত। কিন্তু জাকির কীভাবে সবাইকে রাজি করাত, ফাঁদে ফেলত তা কেউই বুঝতে পারে নাই। আমার মনে হয় সে কিছু একটা জাদু-ম্যাজিক বা অন্য কিছু জানে।’

সুদর্শন চেহারা ও আভিজাতিক চলাফেরার কারণে অনেক নারীই নিজে থেকে তার প্রেমে পড়ে যেতেন বলে শিকার করেছেন।

যেভাবে ধরা পড়লেন জাকির

নারীদের সঙ্গে প্রতারণা করতে নানা ধরনের মাধ্যম ব্যবহার করতেন জাকির, যার মধ্যে একটি ছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেইসবুক। এই ফেইসবুকের মাধ্যমে জাকির অনেক নারীর সাথে পরিচিত হয়ে তাদের সর্বনাশ করতেন। কিন্তু সম্প্রতি ফেইসবুকে পাতানো এক প্রতারণার ফাঁদেই ধরা খেয়েছেন তিনি। কারণ তার দ্বারা প্রতারণার শিকার কয়েকজন নারী ফেইসবুকের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে একত্রিত হয়েছিলেন। তারা জাকিরকে যেকোনো মূল্যে পুলিশের হাতে তুলে দিতে আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেন। অবশেষে ৮ নভেম্বর ভুক্তভোগী কয়েকজন নারী এক হয়ে জাকিরকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন। আর সর্বশেষে মিরপুর পাইকপাড়া এলাকার যে নারীর সঙ্গে জাকির প্রতারণা করেছিলেন, সেই নারীই বাদী হয়ে থানায় ধর্ষণ মামলা দায়ের করেছেন।

মামলার এজাহারে ওই নারী উল্লেখ করেছেন, ব্যবসায়িক পরিচয়ের সূত্র ধরে মাত্র চার মাস আগে জাকিরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এরপর গত ২২ আগস্ট বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে ধর্ষণ করেন জাকির। এরপর ওই নারী জাকিরকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকলে জাকির নানাভাবে তা এড়িয়ে যান। আর বিয়ের প্রলোভন দিয়ে তাকে বারবার ধর্ষণ করতে থাকেন। এরই মধ্যে ওই নারীর কাছে থেকে তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা ও প্রায় এক লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার হাতিয়ে নেন জাকির। নিজে প্রতারিত হচ্ছেন এমনটা যখন বুঝতে পারেন তখন অন্য প্রতারিত নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। এরপরই গত ৮ নভেম্বর পাইকপাড়া এলাকার একটি বাসায় জাকিরকে আটক করেন তারা। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় জাকিরকে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।

পুলিশের ভাষ্য

এই বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জামিউর ইসলাম বলেন, ‘গ্রেফতারের পরে জাকিরকে জিজ্ঞাসাবাদে সে অনেক নারীর সাথে এমনভাবে প্রতারণা এবং বহুবিবাহ করেছেন বলে শিকার করেছে।’

এসআই আরও বলেন, ‘গ্রেফতারের পরে জাকিরকে আদালতে নেওয়া হয়। পরে আদালতের নির্দেশে জাকিরকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ওঠা অন্যান্য অভিযোগ তদন্ত করা হচ্ছে।’

আরএম-২৫/০৪/১২ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্যসূত্র: প্রিয়.কম)