স্টেথিসকোপ আবিষ্কারকের বিস্ময়কর কাহিনী

স্টেথিসকোপ আবিষ্কারকের

স্টেথিসকোপ আবিষ্কার করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিপ্লব এনেছেন তিনি। তার আবিষ্কার দিয়ে তিনি পরিষ্কার আর নির্ভুলভাবে যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় করতে পারতেন।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের দেহেই ব্যবহার করতে হয় নিজের আবিষ্কার, আর শনাক্ত হয় ওই রোগই!

রেনে লেনেক ১৭৮১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের কুইম্পারে জন্মগ্রহণ করেন। রেনে যখন পাঁচ বছরের শিশু, তখন যক্ষ্মায় ভুগে তার মা মিশেল ফেলিচিতে লেনেক মারা যান।

পেশায় আইনজীবী এবং খরুচে হিসেবে দুর্নাম কুড়ানো বাবা থিওফাইল মারি লেনেক তার দুই ছেলের দেখাশোনা করতে অপারগ ছিলেন। ফলে রেনে তার বাবার চাচা অ্যাবে লেনেকের কাছে চলে যান। তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রচারক।

ছোটবেলায় রেনের স্বাস্থ্য খুবই খারাপ ছিল। তিনি অবসন্নতায় ভুগতেন আর মাঝে মাঝে অনেকদিনের জন্য তার জ্বর হতো। ধারণা করা হয়েছিল তার হাঁপানিও আছে। ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে বিষণ্ণতায় ভুগলেও সঙ্গীতের ভেতর তিনি মানসিক শান্তি খুঁজে পেতেন। তার অবসর সময় কাটত বাঁশি বাজিয়ে কিংবা কবিতা লিখে।

১৭৯৩ সালে ফরাসি বিপ্লবের সময় বারো বছর বয়সে রেনে পশ্চিম ফ্রান্সের বুজ শহরে যান। চাচা ডাক্তার গুইলাউমে লেনেক সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ফ্যাকাল্টির ডিন ছিলেন।

বিপ্লবের উত্তাল সময়েও রেনের লেখাপড়ায় কোনো ফাঁকিবাজি ছিল না। তিনি দক্ষতার সঙ্গে ইংরেজি এবং জার্মান ভাষা রপ্ত করেন এবং অনেক পুরস্কারও জেতেন। গুইলাউমে তাকে ডাক্তারি পড়তে উৎসাহ দেন। রেনেও চাচার তত্ত্বাবধানে ডাক্তারি পড়া শুরু করেন। ১৭৯৫ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে রেনে বুজ শহরের হাসপাতালে অসুস্থ এবং আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের সেবা করতে শুরু করেন। ১৭৯৯ সালে আঠারো বছর বয়সে তিনি তৃতীয় শ্রেণীর সার্জন হিসেবে চাকরি শুরু করেন।

রেনে ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী ছাত্র। তিনি ইংরেজি, ল্যাটিন, জার্মান এবং গ্রিক ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ১৮০০ সালে তিনি প্যারিসে অবস্থিত ইকোল প্রাতিক নামের প্রতিষ্ঠানে অঙ্গব্যবচ্ছেদ বিদ্যা শেখার জন্য ভর্তি হন। প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় ১৮০১ সালে রেনে মেডিসিন এবং সার্জারি উভয় বিষয়েই প্রথম হন। ১৮০২ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি তার প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন এবং ১৮০৪ সালে ডাক্তারি পাস করেন।

পারিবারিক হাঙ্গামা, যক্ষ্মায় ভুগে চাচার মৃত্যু ও চাকরি থেকে বেরিয়ে আসায় আর্থিক টানাপোড়েনের সৃষ্টি ইত্যাদি নেতিবাচক ঘটনা রেনের কাজের ধারাবাহিকতা নষ্ট করে। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুস্থ হওয়ার আশায় তিনি ব্রিটানির গ্রাম্য এলাকায় চলে যান। সেখানকার সজীব বায়ু তাকে সুস্থ করে তোলে।

জীবনে এত প্রাপ্তি আর সফলতা সত্ত্বেও রেনের মস্ত এক আক্ষেপ ছিল। প্যারিসের কোনো বড় হাসপাতালে তিনি জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছিলেন না। এটা তাকে হতাশ করে ফেলছিল। অবশেষে ১৮১৬ সালে প্যারিসের নেক্টার হাসপাতালে তিনি নিয়োগ পান এবং খুব খুশি হয়েই সেখানে যোগ দেন। এখানে আসার পরই তিনি বৈপ্লবিক আবিষ্কারটি করেন। এরপর তার জীবনে একটার পর একটা সাফল্য আসতে থাকে।

রেনেকে বলা হয় ক্লিনিক্যাল অস্কাল্টেশনের জনক। তিনিই সর্বপ্রথম নিজের আবিষ্কৃত স্টেথিসকোপ ব্যবহার করে হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনে ব্রঙ্কাইটেসিস এবং সিরোসিস সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেন। এছাড়া তিনি স্টেথিসকোপ ব্যবহার করে ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ, যেমন- নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, ব্রঙ্কাইটেসিস ইত্যাদির শ্রেণীবিভাগ করেন।

১৮২৪ সালে ৪৩ বছর বয়সী রেনে বিয়ে করেন মিস আর্গনকে। এরপর ক্রমেই রেনের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। তিনি খুব দুর্বল হয়ে পড়েন এবং ধরা পড়ে তার যক্ষ্মা হয়েছে। সে আমলে ‘যার হয় যক্ষ্মা, তার ছিল না রক্ষা’।

১৮২৬ সালের মে মাসে রেনের জ্বর, কাশি আর শ্বাসকষ্ট চরম আকার ধারণ করে। তিনি সুস্থ হওয়ার আশায় আবারও ব্রিটানিতে যান। কিন্তু এবারের সফর তাকে পুরোপুরি সুস্থ করতে পারে না। ব্রিটানির আবহাওয়া তাকে কিছুটা উজ্জীবিত করলেও চার মাস পর আগস্টের ১৩ তারিখে, মাত্র ৪৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

রেনে লেনেক ছিলেন নিঃসন্তান। তাই উইল করে তার সব কিছু ভাতিজা মেরিয়াদেককে দিয়ে যান- তার সব গবেষণাপত্র, ঘড়ি, আংটি, সর্বোপরি স্টেথিসকোপ যাকে তিনি আখ্যায়িত করেছিলেন ‘দি গ্রেটেস্ট লেগাসি অফ মাই লাইফ’ বলে।

আরএম-০৯/১২/০১ (অনলাইন ডেস্ক)