সার্কাসের হাতিকে যেভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়

সার্কাসের হাতিকে

হাতির বাচ্চাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মানুষের প্রয়োজনে আয়ত্তে আনা হয়। এই আয়ত্তে আনা বা বশ মানানোর সময় নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়। যা প্রাণিপ্রেমীদের কাছে অমানবিক বলে বিবেচিত। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণি বিভাগের তথ্যমতে, দেশে ৯৪টি হাতি অনুমতি সাপেক্ষে ব্যক্তি মালিকানাধীন রয়েছে। যা দিয়ে পাহাড় থেকে গাছ টেনে নামানো, সার্কাস, অনুষ্ঠানে খেলা ও শারীরিক কসরত দেখিয়ে আয় করা হয়। এ কাজ শেখানোর জন্য একটি হাতিকে ৩-৪ বছর বয়সেই কঠোরভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

মৌলভীবাজারের জুড়ি ও কুলাউড়া উপজেলায় প্রতি বছর ৩-৪টি হাতির শাবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যা স্থানীয় ভাষায় ‘হাদানি’ বলা হয়। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নে গিয়ে হাতি শাবকের প্রশিক্ষণ দেখে উপস্থিত লোকজন, প্রশিক্ষকদের সাথে কথা বলে বিষয়টি অমানবিকই মনে হয়েছে।

নিষ্ঠুরতার প্রথম ধাপ হচ্ছে- হাতির বাচ্চাটিকে মায়ের থেকে আলাদা করা হয়। শাবকটিকে যখন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তখন তাকে প্রচুর অত্যাচার করা হয়। যা তার মা দেখলে প্রশিক্ষকদের উপর আক্রমণ করবে। তাই প্রথমেই মাকে নিরাপদ দূরে রাখা হয়। আলাদা করার পরই শুরু হয় বর্বরতার চরম মাত্রা। নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে সামনে এবং পেছনে বড় বড় গাছের গুড়ি মাটির গভীরে পুতে রাখা হয়। তারপর হাতির শাবকটিকে সামনে-পেছনে, পা ও গলায় পেঁচিয়ে দেয়া হয় বড় বড় রশি।

প্রশিক্ষণের প্রাথমিক পর্যায়ে হাতি শাবককে মালিকের ডাকে সাড়া দেয়ার উপায় শেখানোর চেষ্টা করা হয়। একেকটি পরিচিত শব্দ করেন প্রশিক্ষক আর তাতে সাড়া না দিলে শক্ত বাঁশের লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। কখনো সামনে একটি লাঠি ফেলে রেখে হাতি শাবকটিকে তা শুড় দিয়ে তুলে দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। কথামতো করতে পারলে হাত বুলিয়ে আদর করা হয় কিন্তু কথা না শুনলে আঘাত করা হয়। শাবকটি চেষ্টা করে বাঁধনমুক্ত হতে কিন্তু শুড় তুলে কাতরানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এমনকি বাচ্চাটি শুতে চাইলেও আঘাতের মাত্রা বেড়ে যায়, তাই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আবারো উঠে দাঁড়ায়।

একপর্যায়ে কাঠের গুড়ি থেকে ছাড়িয়ে শাবকটিকে ঘোরানো হয় বেশ কিছুক্ষণ। এটাই নাকি হাতির সঙ্গে মানুষের আন্তরিক সম্পর্ক গঠনে কাজে আসে। এভাবে বেঁধে রেখেই আবার চলে চিকিৎসা। বিভিন্ন লতাপাতার মালিশ দেয়া হয়। ভালো হয়ে গেলে আবার নির্যাতন চলে। দিনের অর্ধেক সময় বেঁধে রেখে বাকি সময় মাঠ ঘুরিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিভিন্ন বিষয় ও মেয়াদী প্রশিক্ষণের এটি প্রাথমিক কোর্স। তবে সাধারণ তিন মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বিভিন্ন ধাপে। এ সময় হাতি শাবককে কলা গাছ, মিষ্টান্ন, বিভিন্ন ভালো খাবারও দিতে হয়।

প্রাণিপ্রেমীরা জানান, কোনো প্রাণির ওপর এ ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ অপরাধ। হাতির প্রশিক্ষণের জন্য আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। প্রাণি গবেষক তানিয়া খান বলেন, ‘যে কোন প্রাণিকে আঘাত করা অপরাধ, আমাদের স্বার্থে একটি প্রাণিকে এত নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার করতে পারি না। বণ্যপ্রাণিকে লোকালয়ে নিয়ে এসে নৈতিকভাবে অপরাধ করছি। তার ওপর এভাবে অত্যাচার করা আইনেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর জন্য আধুনিক পদ্ধতি আয়ত্ত করা উচিত।’

কয়েকজন প্রশিক্ষক এবং মালিক বলেন, ‘এটাই প্রশিক্ষণের নিয়ম। বাংলাদেশে এ ছাড়া ভিন্ন কোনো পদ্ধতি নেই। ভালো কোনো পদ্ধতি থাকলে আমরা সেটাই গ্রহণ করব। থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে আমরা এ নিয়ম দেখেছি।’

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণি সংরক্ষক বিভাগের কর্মকর্তা জাহিদুল কবির বলেন, ‘হাতি প্রশিক্ষণের আধুনিক প্রদ্ধতি আছে, যা একটু সময়সাপেক্ষ। তাই হাতির মালিকরা লুকিয়ে সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। কোন প্রাণিতে অত্যাচার করা অবশ্যই অপরাধ। তাদের উচিত আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা।’

আরএম-১০/১৩/০১ (অনলাইন ডেস্ক)