যুগে যুগে সতিন কাহিনী

যুগে যুগে সতিন

গণমাধ্যমের অপপ্রচারের শিকার বহুবিবাহ : ইউরোপ, আমেরিকায় বহু জরিপে দেখা গেছে, বিবাহিত পুরুষরা গড়ে কমপক্ষে ৯ জন নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এমন অনেক কাহিনী সবার জানা।

বিখ্যাত গায়ক, অভিনেতা, মডেলরা ডজন ডজন প্রেমিকা নিয়ে ঘোরেন, তাতে কেউ আপত্তি করে না। দোষ হয় শুধু কেউ যদি একাধিক বিয়ে করতে চান তখন। বিশ্ববিখ্যাত খেলোয়াড় ম্যারাডোনা বউকে নয় বরং প্রেমিকাকে নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যান, ফটোসাংবাদিকরা তার এ অবৈধ প্রেমিকার ছবি তুলে প্রচার করে- এতে কিন্তু কারও কোনো সমস্যা হয় না। পশ্চিমা বিশ্বের সব সমস্যা পুরুষের একাধিক বিয়েতে।

যুগে যুগে দেশে দেশে সব ধর্মেই পুরুষের একাধিক বিয়ে বৈধ ছিল। আগে সংখ্যার কোনো বিধিনিষেধ ছিল না, কোনো শর্ত ছিল না। ইসলাম এসে শর্ত দিয়েছে, বিয়ের সংখ্যা নির্ধারণ করে দিয়েছে- তা-ও সব দোষ ইসলামের ঘাড়ে ফেলা হচ্ছে। মিডিয়া এমনভাবে ইসলামের বদনাম করে যে অজ্ঞ মানুষ ভাবে- আগে পুরুষ কেবল এক বিয়ে করত। ইসলাম এসে বহু বিবাহ চালু করেছে। পশ্চিমা সমাজ, গণমাধ্যমের অপপ্রচারে মুসলিমরাও এতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। আল্লাহ্ যে কাজকে বৈধ করেছেন, অনেক মুসলিম সেই কাজকে পাপ মনে করছেন।

বাস্তবতা মেনে নেয়া : সিমি চৌধুরীর স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি দুই বাচ্চা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলেন। এমন সময় এক বিবাহিত পুরুষের দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পান তিনি। এমন বিয়ের কথা সিমি ভাবতেও পারছিলেন না। পরে বাস্তবতাকে তিনি মেনে নেন। ৩০ বছর বয়েসী দুই বাচ্চার মার জন্য এর চেয়ে খুব ভালো প্রস্তাব আসবে না।

ই-মেলে বিয়ের শর্ত নিয়ে কথা হল। কোন স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী কতদিন থাকবে, কোন সংসারে কত খরচ দেবে ইত্যাদি। দুই পক্ষ শর্তে রাজি হলে সামনাসামনি দেখা করলেন; বিয়ের তারিখ ঠিক হল। প্রথম স্ত্রী খুশি ছিলেন না; কিন্তু তিনি মেনে নিয়েছিলেন।

দুই পক্ষের বাচ্চারাও বিষয়টি জানে। তারা যে শুধু মেনে নিয়েছে তা নয়, সিমি বললেন, ছোট আম্মুকে দেখার জন্য তার সতিনের মেয়ে রীতিমতো উত্তেজিত। অন্য বাচ্চারাও নতুন ভাইবোনদের দেখতে চাচ্ছে। তিনি আশা করছেন খুব তাড়াতাড়ি একটা পারিবারিক সম্মেলনের আয়োজন করে সবাই সবার সঙ্গে পরিচিত হবে। তার নিজের ছেলেও মার বিয়ে মেনে নিয়েছে। অন্য বন্ধুদের বাবা আছে, তার নেই এ অভাববোধ তাকে কষ্ট দিত।

পুরুষ অভিভাবকশূন্য বাসায় নানা ঝামেলা মা কষ্ট করে একা সামলাচ্ছেন, অনেক সন্তান বোঝে মার এ কষ্ট। তা ছাড়া মা একা তাদের পেছনে যে খরচ করত, নতুন বাবা আসাতে তাদের স্বাচ্ছন্দ্য অনেক বেড়ে যায়- এতেও বাচ্চারা খুশি থাকে।

ব্রিটিশ আইনে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করা অবৈধ; কিন্তু মুসলিমদের জন্য মসজিদ কর্তৃপক্ষ বা ইসলামিক সংস্থাগুলো শরিয়াহ আইনে এমন বিয়ের আয়োজন করছেন। অনেক মুসলিম দাবি করলেন প্রচলিত আইনে এসব বিয়েকে বৈধতা দেয়া এখন সময়ের দাবি।

অনেকে সমালোচনা করে যে এমন বিয়ের মধ্য দিয়ে কিছু পুরুষের লোভ-লালসাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তারা এটা ভুলে যায়- বিয়ে মানে কঠিন দায়িত্ব।

একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী-সন্তান থাকা মানে তার ওপর বিরাট অর্থনৈতিক বোঝা। যারা এ কঠিন দায়িত্ব পালন করছে, সমাজ তাদের সমালোচনা করে; অথচ যারা পরকীয়ার মতো বড় পাপে ডুবে আছে তারা বুক ফুলিয়ে চলে। বিভিন্ন সেলিব্রিটিদের এসব পাপকে মানুষ খুব সহজেই মেনে নেয়।

কল্পনার জগতে বসবাস : ব্রিটিশ নারীরা বাস্তবতা মেনে নিচ্ছেন; কিন্তু এ দেশের লাখ লাখ নারী আর তাদের অভিভাবক বাস্তবতাকে মেনে নিচ্ছেন না। পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। কম বয়সী পুরুষ প্রথম বিয়ে করার সময় ত্রিশের বেশি বয়সের পাত্রীকে নিজেরাও যেমন পছন্দ করে না, তার অভিভাবক, পরিবারের সদস্যরাও সেটা চান না। পাত্রী চাই পোস্টে সবসময়ই দেখা যায় কম বয়সী মেয়েদের জয়জয়কার। অথচ কিছু অভিভাবক পড়াশোনা শেষ করে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে তারপর মেয়েকে বিয়ে করতে শিখিয়েছেন। তাই অনেক উচ্চশিক্ষিতা, চাকরিজীবী মেয়ে আজও অবিবাহিতা। এরপরও তারা সতিনকে মেনে নেয়া তো দূরের কথা, বাচ্চা ছাড়া ডিভোর্স পাত্রকেও না করে দেন। তাদের কল্পনার রাজপুত্রকে পেতে অপেক্ষা করতে করতে এ দেশের ‘বিয়ের বাজারে’ তারা বাতিলের খাতায় নাম লেখাচ্ছেন। কথাগুলো অশোভন; কিন্তু কতটা সত্য, তা যে কোনো ঘটককে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে।

ছোট এক জেলা শহরের ৩৪-৩৫ বছরের মেয়েকে বাচ্চা ছাড়া ডিভোর্স পাত্রের কথা বললেও শিউরে ওঠে। বাচ্চাসহ বিপত্নীক বা ডিভোর্সড পাত্রের কথা তো এই মেয়ে ভাবতেও পারে না। কারণ তার কোনো বান্ধবীর এমন বিয়ে হয়নি। তাই অবিবাহিত পাত্রের আশায় থাকতে থাকতে এই মেয়ে তার বয়স আরও বাড়াতে থাকে, তবুও সে বাচ্চাসহ কাউকে বিয়ে করে পরিচিত মহলে ছোট হতে রাজি নয়। এ মেয়েকে সমাজ এ শিক্ষাই দিয়েছে কোনো পুরুষের দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়া লজ্জার।

অনেক সময় স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য কোনো স্বামী চান আরেক স্ত্রী গ্রহণ করতে। কিন্তু মানবিক কারণে তিনি অসুস্থ স্ত্রীকে তালাক দিতে চান না। পাত্রী পক্ষ থেকে তখন চাপ আসে আগে অসুস্থ বউকে তালাক পরে বিয়ে। অথচ ইসলামের বিধানে কত সুন্দরভাবেই না এখানে সমস্যার সমাধান হতে পারত।

বিবাহিত জীবনে অনেক পুরুষের একাধিক স্ত্রীর চাহিদা থাকে। বৈধভাবে এ চাহিদা পূরণ না হলে তারা বাধ্য হয়ে পাপের পথে পা বাড়াবে। তখন কি একাধিক বিয়েকে যারা স্বীকৃতি দেন না, যারা একে অন্যায় বলে প্রচার করছেন- তারাও এই পাপের ভাগীদার হয়ে যাচ্ছেন না?

যারা একাধিক বিয়ে করতে চান, কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে স্ত্রীদের সঙ্গে ন্যায় আচরণ করবেন, এটাই কামনা।

বিদেশি প্রতিবেদন ও শখের ঘটকালির অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছি এ লেখা।

লেখক : জাবীন হামিদ, সমাজ গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আরএম-০৫/২৭/০৩ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্যসূত্র: যুগান্তর)