অন্ধ-বধির হয়েও ১৩০ দেশ ভ্রমণ

বিশ্বের সবকটি মহাদেশ আমি ঘুরেছি, এমনকি অ্যান্টার্কটিকাও। আমার লক্ষ্য হলো বিশ্বের সবকটা দেশ ভ্রমণ করা। অন্ধ এবং বধির টনি জাইলস বলছিলেন তার স্বপ্নের কথা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও ভ্রমণের নেশায় ১৩০টির বেশি দেশ এরই মধ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি।

টনি জাইলস বলছিলেন, ‘কেউ কেউ হয়তো বলবেন, আমি ভ্রমণের চূড়ান্ত ধাপের উদাহরণ। তাদেরকে আমি দেখাতে চাই যে, আপনি বিকল্প পন্থায়ও বিশ্বকে দেখতে পারেন। ইথিওপিয়া সফরের সময় বিবিসির ট্র্যাভেল শো নামের অনুষ্ঠানে দেয়া সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেন ৪১ বছর বয়সী এই ভ্রমণপিপাসু।

স্পর্শের মাধ্যমে অনুভব
জাইলস গত ২০ বছর ধরে নতুন নতুন জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছেন। বললেন, ‘আমি মানুষের কথা শুনি, পাহাড়ে উঠি, সবকিছু আমি আমার স্পর্শ এবং পায়ের মাধ্যমে অনুভব করি। ওভাবেই আমি একটি দেশ দেখি। সেরকমই একটি সফরের সময় তিনি তার গ্রিক বান্ধবীর সাথে পরিচিত হন যিনি নিজেও অন্ধ।

গত বছর বান্ধবীর সঙ্গে রাশিয়া গিয়েছিলেন। বিশ্বের বৃহত্তম দেশটির এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ট্রেন দিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন দুজনে। তবে অধিকাংশ ভ্রমণে জাইলস একাই ঘুরে বেড়িয়েছেন।

জাইলসের ভ্রমণের অর্থ জোগাড় হয় তার বাবার পেনশনের টাকা থেকে। কাজেই আগে থেকেই যথেষ্ট পরিকল্পনা করে ভ্রমণসূচি ঠিক করেন তিনি। বিমানের টিকিট কাটার ক্ষেত্রে তার মা তাকে সাহায্য করেন, তারণ জাইলসের মতে, অধিকাংশ এয়ারলাইন্স কোম্পানিতেই অন্ধদের জন্য যথেষ্ট সুবিধা নেই।

কোনো দেশে থাকার সময় যারা তাকে সাহায্য করেন, তাদের সঙ্গে আগেই বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ করে নেন তিনি। তাদের সাহায্য নিয়েই তিনি সেসব দেশ ঘুরে বেড়ান। আর এর জন্য ঠিক করে রাখেন সময়সূচি।

জাইলসের কথায়, ‘আমি কোনো বই বা ট্র্যাভেল গাইড দেখে ঠিক করতে পারি না যে একটি দেশের কোথায় কোথায় আমি যাবো। ওই তথ্যগুলো ভ্রমণের আগেই জানতে হয় আমার। তাই আমি আগে থেকেই আমার সূচি ঠিক করে নেই।’

একবার নতুন কোনো দেশে পৌঁছানোর পর সেখানে ভ্রমণের বিষয়টি রোমাঞ্চ জাগায় তার মধ্যে। সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা বলথে গিয়ে জানালেন, ‘মাঝেমধ্যে আমি জানি না যে কার সঙ্গে আমার পরিচয় হবে বা কী হতে যাচ্ছে। আমার কাছে সেটিই অ্যাডভেঞ্চার।’

শারীরিক অক্ষমতা
জাইলসের যখন নয় মাস বয়স, তখন তার চোখের সমস্যা প্রথম ধরা পড়ে। দশ বছর বয়সে তার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। এর আগে ছয় বছর বয়সে তিনি আংশিক বধির হিসেবে চিহ্নিত হন। বর্তমানে কানে শোনার জন্য শক্তিশালী ডিজিটাল হিয়ারিং এইড ব্যবহার করলেও সব ধরনের শব্দ শুনতে পারেন না।

বিশেষ একটি স্কুলে তিনি পড়ালেখা করেন। সেই স্কুল থেকেই ১৬ বছর বয়সে প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণ করেন। এখনো মাঝেমধ্যে নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগেন জাইলস। ২০০৮ সালে কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলে তার কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হয়। বললেন, ‘অন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৈশোরে দীর্ঘসময় আমি বিমর্ষ ছিলাম।’

তার বয়স যখন ১৫ তখন বাবাকে হারান জাইলস। আর ১৬ বছর বয়সে হারান তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে, যিনিও শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিলেন। ‘আমি ওই ঘটনার পরের ছয় থেকে সাত বছরের জন্য মদে আসক্ত হয়ে পড়ি। চব্বিশ বছর বয়সের মধ্যেই আমি পুরোপুরি অ্যালকোহলিক হয়ে যাই।’

জাইলসের বাবা বাণিজ্য জাহাজে কাজ করতেন। শিশু বয়সে বাবার কাছ থেকে শোনা দূরদেশের গল্প জাইলসের মধ্যে আলোড়ন তৈরি করে। তার কথায়, ‘যখন মদের নেশা থেকে আরোগ্য লাভ করি, তখন দেখতে পাই যে সম্পূর্ণ নতুন রাস্তায় জীবন চালানোর সুযোগ রয়েছে।’
২০০০ সালের মার্চে নিউ অরলিন্সে ভ্রমণের মাধ্যমে তার ব্যাকপ্যাকিং অ্যাডভেঞ্চার শুরু হয়। সে সময়কার স্মৃতিচারণ করে বললেন, ‘আমি যানতাম না কোথায় যাচ্ছি। দারুণ চিন্তিত ছিলাম। সেসময় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে বলি ‘টনি, তুমি এই অ্যাডভেঞ্চার না চাইলে বাড়ি যাও।’

সেসময় তিনি পিছু না হটার সিদ্ধান্ত নেন এবং তারপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সবকটি রাজ্য ঘুরে বেড়িয়েছেন। জাইলস বলেন, ‘ভ্রমণ শুরু করার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল নিজের আবেগ থেকে পালানো।‘ নতুন নতুন জায়গায় ভ্রমণের ফলে তার মধ্যে অনেক ইতিবাচক চিন্তারও তৈরি হয়েছে।

একজন মানুষের জীবনে ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন কতটা সেই কথাও জানালেন হাজারো প্রতিবন্ধকতা জয় করে শতাধিক দেশ ভ্রমণকারী টনি জাইলস বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে মেশার পর আমি বুঝতে পারি, আমি অন্ধ বলে তারা আমার সঙ্গে মেশে না, মেশে আমার ব্যক্তিত্বের কারণে।’

জাইলস খুবই কম খরচের মধ্যে ঘোরাঘুরি করেন। যেকোনো জায়গায় তিনি গণপরিবহন ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। থাকার ক্ষেত্রেও একদমই সাদামাটা আবাসস্থল পছন্দ তার। ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, ‘একদম সাদামাটা পরিবেশে থাকতে পছন্দ করি আমি। কেননা এর ফলে আমার সব ইন্দ্রিয় জাগ্রত থাকে।’

সবকিছু স্পর্শের মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করেন জাইলস। অনুভবের মাধ্যমে পরিচয় পেতে চান বিভিন্ন বস্তুর। মানুষের সঙ্গে কথা বলে এবং অন্যদের কথা শুনে নিজের মনে সবকিছুর একটি চিত্র তৈরি করেন তিনি। আদ্দিস আবাবার একটি শিল্পকলা যাদুঘরে সবকিছু ছুঁয়ে অনুভব করার অনুমতি দেয়া হয় তাকে।

জাইলস বলেন, এর ফলে তিনিও উপস্থিত সবার সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেছেন। বিশ্বের অনেক যাদুঘরেই দর্শনার্থীদের এরকম সুযোগ দেয়া হয় না।

যে কোনো জায়গায় সাধারণত দুর্গম পথ এড়িয়ে চলেন জাইলস। অধিকাংশ সময়ই নিজের জন্য আলাদাভাবে গাইড ভাড়া করেন তিনি। তবে মাঝেমধ্যেই গাইড পান না সঙ্গে, এবং কখনো কখনো পথও হারান তিনি।

তবে হারিয়ে গেলেও আতঙ্কিত হন না জাইলস। অপেক্ষা করেন কোনো একজন পথিকের জন্য, যে তাকে সাহায্য করতে পারে। ‘আপনার পাশ দিয়ে হয়তো অনেক মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, এরকম সময় একজন হয়তো জিজ্ঞাসা করে যে ‘আপনি কি হারিয়ে গেছেন? আপনার কি সাহায্য লাগবে?’

তিনি বললেন, অনেকবার তার সঙ্গে এমন হয়েছে। অপরিচিত মানুষ তাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আপ্যায়ন করেছে। অনেকসময়ই অপিরিচিত ব্যক্তিরা তার সফরে তাকে সাহায্য করেছে। তবে জাইলসের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় নতুন দেশে গিয়ে নতুন নোট চেনার ক্ষেত্রে।

তার কথায়, ‘নুতন একটি জায়গায় আমার এমন একজনকে খুঁজে বের করতে হয় যাকে আমি বিশ্বাস করতে পারবো। একজনের সঙ্গে আমার কথা বলে বুঝতে হয় যে সে বিশ্বাসযোগ্য কিনা।‘ কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি তাকে নিয়ে এটিএম বুথে গিয়ে টাকা তোলেন।

অবিশ্বাস্য ভ্রমণকাহিনী
বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানোর সময় জাইলস সেসব অঞ্চলের বিভিন্ন ধরণের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পছন্দ করেন। ‘সঙ্গীত আমার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়গুলোর একটি। সঙ্গীতের মধ্যে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। সঙ্গীত সব বাধা অতিক্রম করতে পারে।’

সব অঞ্চলের স্থানীয় খাবার খাওয়াও তার ভ্রমণের অন্যতম লক্ষ্য থাকে। জাইলস অনেক দর্শনীয় জায়গায় গিয়েছেন এবং অনেক জায়গার ছবিও তুলেছেন। সেসব ছবি জাইলস নিজে হয়তো উপভোগ করতে পারেন না, তবে তার ওয়েবসাইটগুলোতে দর্শকরা সেসব ছবি দেখে বিশ্বের নানা জায়গা সম্পর্কে জানতে পারেন।

অনেকসময় মানুষ তার ভ্রমণের নেশা দেখে হতবাক হয়ে যায়। তারা জিজ্ঞেস করে, ‘একজন অন্ধ ব্যক্তি কেন পৃথিবী ঘুরে দেখতে চাইবে?’ জাইলসের উত্তরটা কিন্তু খুবই সহজ। কেন নয়?

এসএইচ-০৯/২১/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)