মদখোরের আবার বউ বাচ্চা কিসের?

পুরান ঢাকায় যে ছেলেটাকে আমি পড়াতাম তাদের ফ্রিজে মদ থাকত। পানির বোতলের মত করে সাজানো। আমার স্টুডেন্ট আর তার বাবা দুজনে মিলে খাইত। ওদের কাছে মদ খাওয়া ছিল অনেকটা পানি খাওয়ার মত। খিদা লাগলে কিছুটা খেয়ে নিত।

এক সন্ধায় তার পড়ার টেবিলে আমি বসে আছি। টেবিলে ৫০০ ml এর একটা সেভেন আপের বোতল। যে কোন কিছু খাওয়ার একটা বাতিক আছে আমার। বোতল খুলে কিছুটা খেলাম। ভাল লাগল না, আরো কিছু খেলাম। কেমন যেন লাগল। স্টুডেন্ট আসলে বললাম:: সেভেন আপ কত দিন আগে কিনেছ ?? মনে হয় নষ্ট হয়ে গেছে।
স্টুডেন্ট বলে:: আর একটু খান ভাই, এইটা অন্য ফ্লেভারের সেভেন আপ। একটু দামী।

জীবনে ঐ একটা বারের জন্য বেয়ার খেয়েছিলাম, তাও আমার ভুলে আর বোকামি তে। খুব মন খারাপ হয়েছিল। পড়ানোটা ছেড়েই দিতাম কিন্তু পারছিলাম না, কারন টিউশুনিটা আমার ভয়াবহ রকমের দরকার ছিল।
আমার স্টুডেন্টের আম্মা প্রচন্ড মন খারাপ করে বলত:: বাপে পোলায় একসাথে মদ খায়। এ পোলায় পাশ করব তুমি বিশ্বাস কর??।
.
আমি তার চেয়েও মন খারাপ করে বলতাম:: নাহ, আন্টি। আলাদা আলাদা খাইলে একটা চান্স ছিল।
আন্টি মুখ বাকা করে চলে যেত। আমার রসিকতা বুঝত না। বোকাসোকা এই মানুষটার জন্য খুব মায়া হত। মদখোর বাপ ছেলে কে নিয়ে খুব কষ্ট পেতেন।
.
মন খারাপ থাকা মানুষগুলোকে বাইরে দেখে অনেকটা চেনা যায়। যাদের যায় না এরা অভিনেতা। বহু কষ্টেও স্বাভাবিক হাসতে পারে এমন মানুষ আমি দেখেছি। আন্টি বোকা, অস্বাভাবিক বোকা। ঢাকা শহরে তখন আমার নিজেকে ইয়াতিম ইয়াতিম লাগত। এ কারনে মা চেহারার এই মানুষটাকে দেখলেই মায়া লাগত। একদিন অত্যন্ত মরিয়া হয়ে আমার হাত চেপে ধরলেন,:: আমার পোলায় পাশ করব তো??
মায়ের মত মানুষ। মিথ্যা বলাটা খুব কঠিন।
.
পরীক্ষা হয়ে গেল। আমার স্টুডেন্ট নয় টায় ফেইল করল । বাকি দুইটাও করত, কেন যে পাশ করেছে বুঝলাম না। মদ খাওয়া ঐ স্টুডেন্টের ত্রিসিমানায় আর আমি যাই নি। নয় সাব্জেক্টে ফেইল করা স্টুডেন্টের বাসায় আবার যাওয়াটা টিউশুনি শাস্ত্রে নিষিদ্ধ। মানুষে খারাপ বলবে। আরো একটা কারন ছিল পিছনে। আন্টির সামনে আর আমি যেতে চাই নি।
.
তিন বছর পরে আন্টির সাথে দেখা মিডফোর্ডে। চেহারা ভেংগে শুকিয়ে গেছে। অনেকটা কুজো হয়ে হাটছে। অর্থোপেডিক্স ডাক্তার দেখাতে এসেছিল। ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। একটা বিষন্ন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল:: একটা মাইয়া নিয়ে পালায়ে গেছে শুনেছি। মোহাম্মদপুর না কোথায় যেন থাকে”।
আন্টির কথা শুনে মাথায় আমার ঠাডা পড়ল। একমাত্র সন্তান কোথায় আছে সে জানেও না। এত বিষন্ন আর দু:খী চেহারা আমার জীবনে আমি কম দেখেছি। প্রায় কান্না চলে আসল।
.
2.
আমি তখন অর্থোপেডিক্স এ ইন্টার্নী করি। এক মদখোর রুগী পড়েছিল কপালে। কবুতর চুরি করতে যেয়ে দুই তলা থেকে নিচে পড়ে যেয়ে ডান হাত আর ডান পা ভেংগেছে।
অপারেশনের সময় হল। শরীরে কোথাও শিরা খুজে পাওয়া যায় না। এত বেশি ইঞ্জেকশন নিয়েছে যে কোথাও শিরা দেখা যায় না।
ওয়ার্ডে অনেকটা ফেলানো থাকত। তিনবেলা সবাই বকাবকি করত। আমার কেন জানি মায়া লাগত।
.
CV লাইন করার জন্য তিন তলায় ওটিতে নিয়ে গেলাম। মাহতাব স্যার করবে। বিশাল বড় needle যখন গলার পাশ দিয়ে ঢুকাচ্ছে, পাশ থেকে মিন মিন করে বললাম:: স্যার Anaesthesia দিবেন না??
স্যার হাসতে হাসতে বললেন:: এ তো addicted, ব্যাথা পাবে না।
.
CV লাইন করে স্যার চলে গেলেন। রুগীর মুখের উপর থেকে আমি যখন ড্রাপিং সরালাম, দেখলাম ঐ ড্রাপিং দুই যায়গায় ভেজা। বেশ ভালমত কান্নাকাটি না করলে এটি ভেজার কথা না। খুব মায়া লাগল। ওকে যখন হুইল চেয়ারে বসাই তখন আমার দুই হাত ধরে ফেলে বলল:: স্যার, বড় স্যারকে বইলেন আমার খুব ব্যাথা লাগে।
বললাম:: বউ বাচ্চা নেই??
সে বলে:: ছিল স্যার। চলে গেছে।
হুম, তাইত। মদখোরের আবার বউ বাচ্চা কিসের??
.
3. দিনের বেলায় গুলিস্থানে কিছু মদখোর পাওয়া যায়। এরা আবার এক ধাপ এগিয়ে। হাতে পলিথিন জড়িয়ে সেই হাতে মানুষের গু নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। আপনি সামনে পড়লেন তো ধরা খাইলেন। টাকা ছাড়বেন তো মুক্তি পাবেন। নইলে তাজা গু দিয়ে আপনাকে মাখামাখি করে দিবে। অদ্ভুদ সমস্যা।
মদ এমন জিনিষ যে মানুষের তাজা গু এদের কাছে ছোটখাট ব্যাপার।
.
4. মুন্সিগঞ্জে আমার একটা পিয়ন ছিল। রাতে ডাকলে মুরগীর চোখের মত লাল চোখ বের করে বলত:: যে ছার বলেন। ” এইটা প্রতিরাতে মদ খাইত। পরে শুনেছি ওর বয়েসি ওর বন্ধুগুলো সবাই মদ খায়। মদ খায় না এমন কাউকে সে কম দেখেছে।
.
উপরের ঘটনাগুলো বাংলাদেশের খন্ডচিত্র নয়, পুরো চিত্র। আমাদের প্রায় অজান্তে এদেশে একটা মদ প্রজন্ম গড়ে উঠেছে। এর মুলে রয়েছে মাদক দ্রব্যের সহজলভ্যতা আর চরম দুর্নীতিপরায়ন প্রশাসন। এদেশের বহু বাবা মা আজ রাতে ঘুমায় না ছেলের চিন্তায়।
এক সিস্টারের সাথে গল্প করলাম। ওটিতে মন খারাপ করে বসেছিল একা একা। মন খারাপের কারন জিজ্ঞাসা করলে বলল:: ছেলেটার রুম থেকে সিগারেটের গন্ধ আসে। সামনে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা। বন্ধুর বাসায় রাত কাটায়। কিছু বললে শক্ত শক্ত কথা বলে। ছেলেটা এমন ছিল না বলে কেঁদে দিল।
এই সিস্টারের মত বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা মা আজ বিষন্ন মন নিয়ে বসে থাকে। ছেলেটা কি করে? কার সাথে মিশে? কি খায়?
.
বহু দিন পর আজ সেই মা মা চেহারার বোকা আন্টির কথা মনে পড়ল। আকুল হয়ে বলা…” আমার পোলায় পাশ করব তো?””

এসএইচ-১৬/২০/২০ (অনলাইন ডেস্ক)