হতভাগ্য মানুষগুলো একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে লোহার শেকলে বাঁধা থাকত যে নড়ার উপায় ছিল না। নিজে আঘাত না পেয়ে কিংবা অন্যকে আঘাত না দিয়ে অন্যপাশেও ফিরতে পারত না তারা। প্রতি সকালেই দেখা যেত একজন জীবিতর পাশে পড়ে রয়েছে লাশ।
এভাবেই ঊনবিংশ শতকের ইউরোপগামী দাসবাহী জাহাজের বর্ণনা দিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন রেভারেন্ট জন নিউটন। প্রায় ৩০০ বছর ধরে চলা ঔপনিবেশিকদের এমন নির্যাতন থেকে আত্মাহুতি দিয়ে রেহাই পেতেন কেউ কেউ। তবে নিশ্ছিদ্র পাহারায় সেটাও যারা পারতেন না মৃত্যুর চেয়েও কঠিন যন্ত্রণায় ভুগতে হত।
হাতে-পায়ে শিকল পড়ে একসময় হাজির হতেন ইউরোপ কিংবা আমেরিকার মাটিতে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই এমন দাসপ্রথা নিষিদ্ধ। তবে সত্যিটা হচ্ছে, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এর মৃত্যু ঘটেনি।
আধুনিক দাসপ্রথার কুখ্যাত শিকার হচ্ছে যৌনদাসীরা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বাণিজ্যিক যৌন নিষ্পেষণের শিকার হয়েছেন প্রায় ৪৮ লাখ মেয়ে, শিশু ও নারী। শিশু পর্ণোগ্রাফি, পতিতালয় কিংবা নাইটক্লাবে জোরপূর্বক শরীর বিক্রি করে চলছেন তারা। শতাংশের হিসেবে এশিয়ার দায়টাই বেশি। মোট যৌনদাসীদের ৭৩ ভাগ এই মহাদেশের।
তবে বাদ যায়নি আলোকায়নের নামে একসময় ঔপনিবেশিক দাসরাজ্য কায়েম করা আধুনিক ইউরোপিয়ান দেশগুলোও। নারী আর মেয়ে শিশুর মাংস বিক্রির বাজারে তাদের ভাগ ১৪ শতাংশ। সাধারণত দারিদ্র্য আর অর্থনৈতিক দুর্দশায় পতিত মধ্য ও পূর্ব ইউরোপ থেকে শুরু হয় ইউরোপিয়ান যৌন দাসপ্রথা চক্রের।
কাজ দেয়ার নাম করে মলদোভা, আলবেনিয়া, স্লোভেনিয়ার মতো দেশগুলো থেকে নারীদের পাচার করে বিক্রি করে দেয়া হয়, উন্নত আর উদারনৈতিক হিসেবে দাবি করা যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্সের মতো দেশগুলোতে। যার মুল ভূমিকায় থাকে ভয়ঙ্কর মানব পাচারকারী চক্র।
বসনিয়ান জনা কোহুর বর্ণনায় উঠে আসে পাশবিক প্রক্রিয়ার পুরোটা। তার মতে, স্লোভেনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় কাজ খুঁজছিলাম। আমার সদ্য পরিচিত বন্ধু রোমানা আমাকে একটি অ্যাকাউন্টিং ফার্মে সাক্ষাৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। সেখানে আমার জন্য একজন নারী অপেক্ষা করছিলেন। ১০ মিনিট কথাবার্তার পর হঠাৎ দুজন লোক আসে চোখ বন্ধ করে জোর করে আমাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। তারা আমাকে ধর্ষণ করে ও ইচ্ছেমতো মারতে থাকে।
তারপর শরীরে হিরোইনের সুচ ঢুকিয়ে দেয়। আমি বাঁধা দিলে আবার আমাকে ধর্ষণ করা হত। একসময় আমাকে পর্ণোগ্রাফির পোশাক পরতে বাধ্য করা হয়। ভাগ্যের জোরেই হয়তো বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন তিনি। চার মাস নরক বাসের পর অজানা এক লোকের সহায়তায় পালিয়ে আসতে সমর্থ হন জনা।
তবে তার মতো কপালটা যাদের চওড়া না আমস্টারডাম কিংবা লন্ডনের কোনো অন্ধকার গলিতেই শেষ হয়ে যায় তাদের তারুণ্য। অন্যদিকে সভ্যতার নামে প্রহসন চলতে থাকে পৃথিবীর সঙ্গে। ঠিক যেমনটি হয়েছে নেদারল্যান্ডসের আইনে।
২০০০ সালে পতিতাবৃত্তি বৈধ করে দেয় ডাচ সরকার। যুক্তি দেয়া হয়, এর ফলে কমে আসবে নারী ও মেয়ে শিশু পাচারের হার। বর্তমানে দেশটিতে ১২০০ এরও বেশি যৌনপল্লী রয়েছে। তবে আসলেই কি থেমে আছে নেদারল্যান্ডসের নারী ও মেয়ে শিশু পাচার? অর্থনৈতিক হিসাব বলছে, যৌনব্যবসা থেকে প্রতি বছর ৬৬ কোটি ইউরো আয় করে ডাচরা।
বিপরীতে দেশটির যৌনপল্লীর বৈধতা দানের আসল বাস্তবতার সাক্ষী এই নারীর রক্তমাখা মুখ। আর অন্যদিকে এই নারীর নির্যাতনকারী শাবান বারান বান্ধবীকে নিয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করেন পৃথিবীর। দুই বছরে ১৩০ জনেরও বেশি নারীকে পাচার করে এই শাবান। যাদের অধিকাংশ পূর্ব ইউরোপের। অথচ গ্রেফতার করেও একদিনের জন্য ছেড়ে দেয় ডাচ সরকার।
সুযোগ বুঝে নিজ দেশ তুরস্কে পালিয়ে আসে শাবান। আমস্টাডাম কিংবা হেগের নিয়ন আলোয় আলোকিত জানালার পিছনে। গুমরে কাঁদেন সেই হতভাগ্য বিষাদগ্রস্ত নারীরা। অথচ মুখে হাসি নিয়ে অপরিতি পুরুষকে আনন্দ বিলিয়ে যান যারা। আনন্দ উপভোগকারীরা কি জানেন সেই হাসির দাম কত?
এসএইচ-২০/০৭/২০ (অনলাইন ডেস্ক)