বেইজিং বিমানবন্দরে বিমানে ওঠার সময় চোখ বেড়ে অশ্রু ঝর ছিল লি মেং চু এর। তিনি একজন তাইওয়ানের নাগরিক। সম্প্রতি তিনি চীনের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
চীনা পুলিশের ছবি তোলায় তাকে ১ হাজার ৪০০ দিনের বেশি আটকে রাখা হয়। তার অপরাধ, তিনি চীনের পুলিশের ছবি তুলেছিলেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি ও রাষ্ট্রীয় গোপন নথি চুরির অভিযোগ আনা হয়।
তাইওয়ানের এই নাগরিক মূলত ব্যবসায়ী। বহুবার তিনি চীনে গিয়েছেন। দেশটির জিয়াংসু প্রদেশের সুঝৌ শহরে থাকতেন। এ ছাড়া বছরে দুবার তিনি চীন যান। কিন্তু একটি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের কাজে ২০১৯ সালের আগস্টে শেষবার তিনি যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। সেই সময় হংকংয়ের গণতন্ত্রকামীরা আন্দোলন করছিলেন। বলা হয়, এই আন্দোলন হংকংয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আন্দোলন। কারণ, ওই সময় প্রায় প্রতি সপ্তাহে পুলিশ–বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছিল।
ওই বিক্ষোভে তারও সমর্থন ছিল। সে সময় তিনি হংকং ভ্রমণও করেন। এরপর তিনি চীনের মূল ভূখণ্ড শেনঝেনে চলে যান তার এক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করতে।
শেনঝেনে গিয়ে তিনি দেখেন স্টেডিয়ামে শত শত পুলিশ সদস্য জড়ো হচ্ছেন এবং সাঁজোয়া যান সেখানে আনা হয়েছে। ওই সময় অনেকেই এটা ভেবে ভয় পাচ্ছিলেন যে নিরাপত্তা বাহিনীর এসব সদস্যকে হংকংয়ে পাঠানো হবে বিক্ষোভ দমনের জন্য। এই পুলিশ সদস্যদের স্টেডিয়ামে জড়ো হওয়ার দৃশ্য লি হোটেলকক্ষের জানালা দিয়ে দেখেছিলেন। এরপর তিনি সেখানে গিয়ে এর ছবি তুলেছিলেন। লি বলেন, সেখানে কোনো সতর্কসংকেত দেওয়া হয়নি। অনেকেই সেখানে ছবি তুলছিলেন। পুলিশের যে বেষ্টনী, তা-ও তিনি অতিক্রম করেননি।
লি যখন শেনঝেন থেকে তাইওয়ানে ফিরছিলেন, তখনই বিপত্তি ঘটে। বিমানবন্দরে তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তার ব্যাগ ও মুঠোফোনে তল্লাশি চালানো হয়। এ সময় তার ব্যাগে লিফলেট পাওয়া যায় এবং মুঠোফোনে ছবি পাওয়া যায়। এরপর চীনের জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাকে একটি হোটেলে আনেন। ওই হোটেলে তাকে আটকে রাখা হয় ৭২ দিন। ওই দিনগুলোয় তিনি ঘর থেকে বের হতে পারেননি। তাকে টেলিভিশন দেখতে দেওয়া হয়নি, কোনো সংবাদপত্র তাকে পড়তে দেওয়া হয়নি, ওই ঘরের জানলার পর্দা তোলা তার জন্য নিষেধ ছিল। এমনকি কথা বলাও তার জন্য নিষেধ ছিল। ওই সময় তিনজন তার ওপর নজর রাখতেন।
চীনের অধিকারকর্মীদের বক্তব্য অনুযায়ী জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে- এমন অপরাধে কোনো ব্যক্তিকে আটক করলে ওই ব্যক্তিকে এভাবেই গোপন স্থানে আটক করে রাখা হয়। কোনো বিচার ছাড়াই এভাবে মাসের পর মাস আটক রাখা হয় তাদের।
লির ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে। পরে তাকে একটি আটক কেন্দ্রে নেওয়া হয়। এরপর একসময় লিকে টেলিভিশনে দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তাকে বলতে শোনা যায়, মাতৃভূমির ক্ষতি করায় তিনি দুঃখিত।
তার ধারনা ছিল দোষ শিকার করলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু না তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। বিচার শুরু হলে তার ১ বছর ১০ মাস কারাদণ্ড হয়। অভিযোগ, বেআইনভাবে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পাচার এবং বিদেশি গুপ্তচর হিসেবে কাজ করা। এই ঘটনার খবর রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হয়। এতে বলা হয়, লি ওই স্টেডিয়াম থেকে ছবি তুলেছিলেন তাইওয়ানের বিভিন্ন গ্রুপের কাছে পাঠানোর জন্য। তিনি তাইওয়ানের স্বাধীনতাকামী।
লি ছিলেন গুয়াংডং কারাগারে। যে ছোট্ট কক্ষে তাকে রাখা হয়েছিল, সেখানে আরও ১৫ জন থাকতেন। সেখানে কষ্ট হলেও তার জন্য খানিকটা স্বস্তির ছিল। কারণ, সেখানে তিনি অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। তবে ওই গুয়াংডং কারাগারে লিকে কাজ করতে হতো। সেই কাজ ঠিকমতো করতে না পারলে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো।
শেষ পর্যন্ত লি ২০২১ সালে জুলাইয়ে মুক্তি পান। এই সময় চীনের পুলিশ তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করে। পরে তিনি সাংহাই হয়ে তাইওয়ানের ফেরার চেষ্টা করেন। কিন্তু অভিবাসন কর্মকর্তারা তাকে আটকে দেন। এরপর লি বুঝতে পারেন, তিনি আসলে পুলিশের নজরদারিতে আছেন।
লি যখন বুঝতে পারেন তিনি আসলে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে বের হতে পারবেন না, তখন তিনি ১০০টা শহর ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত নেন। শেষ পর্যন্ত তিনি চীনের নাগরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। এর মধ্যে আইনজীবী যেমন ছিলেন, তেমনি অধিকারকর্মীও ছিলেন। অনেকেই তার প্রতি সদয় হন। তাকে থাকার বন্দোবস্তও করে দেন।
লি জাপান হয়ে তাইওয়ানে ফিরছেন। চীন সম্পর্কে তার যে ধারণা আগে ছিল, তা বদলে গেছে।
এসএইচ-০৭/২৯/২৩ (অনলাইন ডেস্ক)