পাক হানাদারদের প্রতি আত্মসমর্পণের আহ্বান মিত্রবাহিনীর

আজ ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১। যুদ্ধ জয়ের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। বিজয় অনিবার্য। যুদ্ধের শুরুতে সুশিক্ষিত পাক সেনাপতিরা ব্যঙ্গ করে বলেছিল, আমরা স্কাউটদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি! কিন্তু মাত্র ৯ মাসেই মুক্তিপাগল বাংলার দামাল ছেলেদের অর্থাৎ তাদের ভাষায় স্কাউটদের কাছেই এমন মার খেতে হবে, মাথা নিচু করে দু’হাত তুলে প্রাণ বাঁচাতে আত্মসমর্পণ করতে হবে; এটা তাদের কল্পনাও ছিল না। বাস্তবে তাই হয়েছে।

একাত্তরের এদিন চারদিকে শুধু পাক হানাদারদের পতনের খবর। ঢাকা থেকে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর বেরোবার সব পথ বন্ধ। বন্ধ হয়ে যায় তাদের ঢাকায় প্রবেশের পথও। সর্বত্র মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযান। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ঢাকা দখল। বাংলার মুক্তিপাগল বীর বাঙালীর কাছে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে প্রশিক্ষিত পাক সেনারা। মাত্র একদিন আগেই বেতারসহ বিমানে হাজার হাজার লিফলেট ছড়িয়ে পাক হানাদারদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায় মিত্রবাহিনী। মিত্র ও মুক্তিবাহিনী বীরদর্পে দেশের অধিকাংশ জেলায় বিজয় কেতন উড়িয়ে ঢাকা দখলের জন্য মরিয়া। একটাই লক্ষ্য- হানাদার ও তাদের দোসরদের পরাজিত করে চূড়ান্ত বিজয়। তাই চারদিক থেকে ঘিরে ঢাকামুখী মিত্রবাহিনী।

একাত্তরের ডিসেম্বরের এদিন চারদিক থেকে মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হলো। তখন তাদের চোখের সামনে শুধু ঢাকা। এর আগেই তাদের প্রথম লক্ষ্যটা পূরণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ মিত্রবাহিনী দেশের ভেতর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা পাকিস্তানী বাহিনীকে বেশ ভালভাবেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। তাদের ঢাকায় ফেরা বা পালানোর প্রায় সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এবার দ্বিতীয় লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেল মিত্রবাহিনী। দ্বিতীয় লক্ষ্যটা হলো- দ্রুত ঢাকায় পৌঁছানো এবং সেখানে থাকা পাকিস্তানী বাহিনীর মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দিয়ে জেনারেল নিয়াজীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা।

সব দিক থেকেই মিত্রবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হলো। মিত্রবাহিনী আগে পৌঁছে গেল আশুগঞ্জে, দাউদকান্দিতে এবং চাঁদপুরে। পশ্চিমে একটি বাহিনী পৌঁছল মধুমতি নদীর তীরে। আরেকটা বাহিনী কুষ্টিয়াকে মুক্ত করে চলল গোয়ালন্দঘাটের দিকে। হালুয়াঘাট থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীও পৌঁছে গেল ময়মনসিংহের কাছাকাছি। নৌবাহিনীর গানবোটগুলোও ততক্ষণে নানা দিক থেকে এগুচ্ছে ঢাকার দিকে এবং বিমান বাহিনীর আক্রমণও পুরোদমেই চলছে।

এদিন বিকেলে মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরা কলকাতায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা এখন ঢাকা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলেন, পাকিস্তানীরা যদি মাটি কামড়ে ঢাকার লড়াই চালাতে চায় তাহলে আপনি কী করবেন? জেনারেল অরোরা জবাব দিলেন, ওরা (পাকিস্তানী বাহিনী) কী করবে জানি না। তবে আমরা বড় ধরনের লড়াইয়ের জন্যই প্রস্তুত।

সাংবাদিকরা আবারও প্রশ্ন করলেন, ঢাকাকে মুক্ত করার পথে আপনার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা কী? অরোরা জানালেন, নদী। তারপর আবার বললেন, নদী যদিও বড় বাধা, কিন্তু সে বাধা অতিক্রমের সব ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি। আমাদের পদাতিক সৈন্য এবং রসদ পারাপারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আর আমাদের পিটি ৬৭ ট্যাঙ্কগুলো নিজে থেকেই নদী সাঁতরে যেতে পারবে।

এদিকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর প্রচ- আক্রমণের মুখে দাঁড়াতেই পারছিল না পাক হানাদাররা। আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারেনি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশ-ভারত যৌথবাহিনীর কমান্ডের কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরা বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী দু’দিক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এক অংশ রয়েছে হিলির উত্তরে, আরেকাংশ রয়েছে দক্ষিণে। দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের আক্রমণ মিত্রবাহিনীর আক্রমণের গতিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।

নয়াদিল্লীতে ভারত সরকারের জনৈক মুখপাত্র বলেন, পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধবিরতির প্রশ্নটি অবশ্যই একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কেননা, বাংলাদেশ সরকারকে আমরা বৈধ সরকার মনে করি। এই বিবৃতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিনাশর্তে মুক্তিদানের কথাও উল্লেখ করা হয়।

কিন্তু চীন কোনভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফি এক ভাষণে বলেন, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ শুরু করেছে। ভারত তথাকথিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। চীনের কাছে বাংলাদেশ ছিল তথাকথিত বাংলাদেশ! তথাকথিত বাংলাদেশ বলে মূলত বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করতে চায়নি চীন।

এদিন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা ও আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় কংগ্রেসের সমন্বয়ে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পর এটিই ছিল উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠক। বৈঠকে মুক্ত এলাকায় অসামরিক প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু এবং খাদ্য, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় অনিবার্য। এটা বুঝতে পেরেও পাক শাসকরা তাদের বন্ধুরাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ করে স্বাধীনতা ঠেকাতে ব্যর্থ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে বাঙালীকে নেতৃত্বশূন্য করতেও গোপন ষড়যন্ত্র আঁটতে শুরু করে তারা। আর এ পরিকল্পনার প্রধান নায়ক স্বাধীনতার প্রধান শত্রু এদেশীয় জামায়াতের রাজাকার-আলবদর-আলশামস।

এসএইচ-০১/০৯/১৯ (অনলাইন ডেস্ক)