আনন্দ-বেদনায় মিশ্র মহান বিজয় দিবস আজ। বিজয়ের গৌরবের- বাঁধভাঙ্গা আনন্দের দিন। একই সঙ্গে লাখো স্বজন হারানোর শোকে ব্যথাতুর-বিহ্বল হওয়ারও দিন। তীব্র শোষণের কুহেলী জাল ভেদ করে একাত্তরের এই দিনটিতে প্রভাতী সূর্যের আলোয় ঝিকিমিকিয়ে উঠেছিল বাংলার শিশির ভেজা মাটি, অবসান হয়েছিল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সাড়ে তেইশ বছরের নির্বিচার শোষণ, বঞ্চনা আর নির্যাতনের কালো অধ্যায়ের। নয় মাসের জঠর-যন্ত্রণা শেষে এদিন জন্ম নেয় একটি নতুন দেশ-স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। ঝড়ের ভেতরে বিকশিত অটল বৃক্ষের জীবন্ত প্রতীক স্বাধীনতা নামের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আজও প্রচণ্ড ঝাঁকি দেয় রক্তে, শাণিত করে চেতনা।
বাঙালী আঘাত খেয়েছে বার বার, কিন্তু কখনও আহত পাখির মতো আর্তনাদ করেনি, ভেঙ্গে পড়েনি ব্যর্থতার ক্রন্দনে। সমস্ত আঘাত সে বুক পেতে নিয়েছে, সর্বাঙ্গ রুধির মেখে অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেটির উদয় ঘটে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরে। বহু শতাব্দীর স্বপ্ন-স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে। অবর্ণনীয় দুর্যোগে লণ্ডভণ্ড হওয়া বাংলাদেশের বঞ্চিত ও শোষিত মানুষ রুখে দাঁড়ায় সর্বশক্তি দিয়ে। আত্মবিস্মৃত বাঙালী আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে উৎসর্গ করে নিজ ও স্বজনকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ ২৪ বছরের লড়াই-সংগ্রাম এবং তাঁর নেতৃত্বে-নির্দেশে বাঙালী জাতির এক সাগার রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে বিজয়, লাল-সবুজ পতাকা সংবলিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
পূর্বাচলে আজ উদিত যে-সূর্য, প্রতিদিনের হয়েও সে প্রতিদিনের নয়; তার রক্তিমতায় তিরিশ লাখ শহীদের রক্ত আমাদের মনে পড়বে; আকাশ যে-কোমলতায় আজ উদ্ভাসিত, একাত্তরের সম্ভ্রমহারা দশ লাখ মা-বোন-জায়ার ক্রন্দনধোয়া সে-উদ্ভাস। ভোরের যে-রাঙা আলোটি আজ স্পর্শ করেছে ভূমি, স্বদেশের সেই পবিত্র ভূমি ভিজে আছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রক্তে; আর সেই রক্তস্রোতে মিশে আছে জাতীয় চার নেতার উষ্ণ শোণিত। দেনদরবার নয়, কারও দয়ার দানে নয়, সাগর-সমান রক্তের দামে বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বাধীনতা, রক্ত-সাগর পেরিয়ে বাঙালী জাতি পৌঁছেছে তার বিজয়ের সোনালি তোরণে। বিজয়ের আটচল্লিশ বছর পূর্তিতে তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ।
৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ দেশে ৫০ বছর আগে আজকের এই দিনে উদয় হয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সূর্য। সেদিনের সেই সূর্যের আলোয় ছিল নতুন দিনের স্বপ্ন, যে স্বপ্ন বাস্তবায়নে অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল এ দেশের ৩০ লাখ মানুষ। ৪৯ বছর পরও সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পায়নি, শেষ হয়নি মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কুয়াশায় জড়ানো হালকা শীতের বিকেলে রমনার রেসকোর্স ময়দানে দাম্ভিক পাকিস্তানী সেনারা যে অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে বাঙালীর বুকে, হাতের সেই অস্ত্র পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর নেতাদের সামনে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিল বৃহস্পতিবার। এদিনের সকালে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের কর্মকর্তা জন আর কেলি পৌঁছান সেনানিবাসের কমান্ড বাঙ্কারে। সেখানে নিয়াজী নেই, ফরমান আলীকে পাওয়া গেল বিবর্ণ ও বিধ্বস্ত অবস্থায়। নিচু কণ্ঠে ফরমান আলী জানান, আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত ভারতীয় বাহিনীর প্রস্তাব তারা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় ভারতে সেই সংবাদ পাঠাতে পারছেন না। কেলি প্রস্তাব দিলেন, জাতিসংঘের বেতার সঙ্কেত ব্যবহার করে তিনি বার্তা পৌঁছে দিতে পারেন।
আত্মসমর্পণের জন্য বেঁধে দেয়া সময় সকাল সাড়ে নয়টা থেকে আরও ছয় ঘণ্টা বাড়ানো ছাড়া ভারতীয় বাহিনীর সব প্রস্তাব মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণের বার্তা পৌঁছানো হয় জাতিসংঘের বেতার সঙ্কেত ব্যবহার করে। ভারতে তখন সকাল নয়টা ২০ মিনিট। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের (বর্তমান শেক্সপিয়ার সরণি) একটি দোতলা বাড়ি। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিবালয় আর প্রধানমন্ত্রীর দফতর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল। বরাবরের মতো সেদিনও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কক্ষের দরজা একটু খোলা। উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী অভ্যাসবশে ডান হাতের আঙ্গুল কামড়াচ্ছেন।
আনুমানিক সকাল ১০টায় তাজউদ্দীন আহমদের ফোনটি বেজে উঠল। ওই ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছাড়া ফোন করতে পারে না। কী কথা হলো বোঝা গেল না। কিন্তু ফোন রেখে, চোখেমুখে সব পাওয়ার আনন্দ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানালেন- ‘সবাইকে জানিয়ে দাও, আজ আমরা স্বাধীন। বিকেল চারটায় আত্মসমর্পণ।’ প্রধানমন্ত্রী নিজেই অবশ্য খবরটি সবাইকে শোনালেন। আর বললেন, কাজের প্রথম পর্যায় শেষ হলো কেবল। এবার দ্বিতীয় পর্যায় দেশ গড়ার কাজ এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।
এদিকে ঢাকায় পাকা খবর এসে পৌঁছেছে কিছুক্ষণ আগে। আত্মসমর্পণ হবে বিকেল সাড়ে চারটায়। ঢাকাবাসী কী করবে আর কী করবে না বুঝে উঠতে পারছে না। সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করল। এর আগেই মিরপুর ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় ঢুকে পড়েছে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী। পৌষের এক পড়ন্ত বিকেলে ঢাকা রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রস্তুত হলো ঐতিহাসিক এক বিজয়ের মুহূর্তের জন্য। ঠিক যেখান থেকে জাতির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের সাতই মার্চ বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন।
বেলা একটা নাগাদ কলকাতা থেকে ঢাকা এসে পৌঁছান ইস্টার্ন কমান্ডের যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব, মুক্তিবাহিনীর উপ-অধিনায়ক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকার (সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী)। দুপুর একটার পর জেনারেল হেড কোয়ার্টারে বসে আত্মসমর্পণের দলিল তৈরির বৈঠক হয়। এক পক্ষে নিয়াজী, রাও ফরমান আলী ও জামশেদ। অপর পক্ষে জ্যাকব, নাগরা ও কাদের সিদ্দিকী।
সিদ্ধান্ত হয়, দলিলের স্বাক্ষর করবেন বিজয়ী বাহিনীর পক্ষে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর জয়েন্ট কমান্ডিং ইন চীফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পরাজিত বাহিনীর পক্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই জেনারেল অরোরা আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বিমান ও নৌবাহিনীর চীফ অব স্টাফসহ কলকাতা থেকে ঢাকায় পৌঁছান। নিয়াজী অভ্যর্থনা জানান যৌথ বাহিনীর কমান্ডারকে। এরপর আসে সেই মাহেদ্রক্ষণ। পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী রেসকোর্স ময়দানে এলেন। সামরিক বিধি অনুসারে বিজয়ী ও বিজিত সৈনিকরা শেষবারের মতো জেনারেল নিয়াজীকে গার্ড অব অনার জানায়।
বিকেল চারটায় নিয়াজী ও অরোরা এগিয়ে গেলেন ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। জেনারেল অরোরা বসলেন টেবিলের ডান দিকের চেয়ারে। বাম পাশে বসলেন জেনারেল নিয়াজী। দলিল আগে থেকেই তৈরি ছিল। জেনারেল অরোরা স্বাক্ষর করার জন্য দলিল এগিয়ে দেন নিয়াজীর দিকে। তখন বিকেল ৪টা ৩১ মিনিট। অবনত মস্তকে জেনারেল নিয়াজী দলিলে স্বাক্ষর করে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নিলেন স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে এ সময় উপস্থিত ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার।
দীর্ঘ নয় মাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে বাঙালী জাতির জীবনে এলো নতুন প্রভাত। এলো হাজার বছরের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। পাক হানাদারদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাঙালী জাতি অর্জন করে তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি, লাল-সবুজের অহঙ্কৃত পতাকা, বিশ্বমানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম জাতি হিসেবে নিজেদের গর্বিত পরিচয়। বিজয়ের মুক্তির নিশান ওড়ে বাংলার সর্বত্র। রক্ত লাল পতাকায় সিঞ্চিত হয় বাঙালীর চেতনা।
আজ সরকারী ছুটির দিন। সকল সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারী ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাসমূহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।
এসএইচ-০২/১৬/২১ (অনলাইন ডেস্ক)