ভয়ঙ্কর সব রোগের ঔষধ নষ্ট ওয়াইন!

ভয়ঙ্কর সব রোগের

বিজ্ঞান বিভিন্ন সময়ে মানবজাতিকে ভয়ঙ্কর সব বিপদ থেকে রাক্ষা করে আসছে। বিজ্ঞানের পিছনের মানুষগুলোও সব সময়ই মানব কল্যাণে নিরলস পরিশ্রম করে গিয়েছেন। কখনো বছর বছরের পরিশ্রম আর সাধনা কাজে লেগেছে আবার কখনো বা দূর্ঘটনাবশত বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে ফেলেছে এমন সব প্রযুক্তি যা রক্ষা করেছে লাখ লাখ মানুষের জীবন। এমনই একজন ফ্রান্সের রসায়নবিদ লুইস পাস্তুর। যে কিনা দূর্ঘটনা বশত ওয়াইন পরীক্ষা করতে গিয়ে এমন এক আবিষ্কার করেছিলেন যা মানবসভ্যতাকে চিরতরে বদলে দেয়। তাহলে জেনে আসা যাক লুইস পাস্তুরের সেই আবিষ্কার সম্পর্কে যা কিনা পরবর্তীতে রক্ষা করবে পুরো মানব সভ্যতাকে।

প্রাচীনকাল থেকেই মদ্যপান ইউরোপের মানুষের সংস্কৃতির অংশ। এসকল মদের মধ্যে মধ্যযুগে সবথেকে জনপ্রিয় ছিল ওয়াইন। ওয়াইনের স্বাদ এবং উপকারিতাও ছিল অন্যান্য সকল মদের থেকে বেশি। কিন্তু ওয়াইনের কিছু সমস্যাও ছিল। অন্যান্য মদের মত না হওয়ায় ওয়াইন নস্ট হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি ছিল। এই ওয়াইন্স নষ্ট হওয়ার প্রবণতা এতটাই বেশি ছিল যে তা একসময় ফ্রান্সের জাতীইয় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ফ্রান্সের তখনকার অর্থনীতির বেশিরভাগই নির্ভর করত ব্রিটেন এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে ওয়াইন রপ্তানির মাধ্যমে।

সমস্যা সমাধানে ১৮৫৬ সালে তখনকার ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন ফ্রান্সের সবথেকে জ্ঞানী রসায়নবিদ লুইস পাস্তুরকে দায়িত্ব দেন। লুইস পাস্তুর শুধুমাত্র রসায়নে পারদর্শীই ছিল না বরং তার পূর্বে এলকোহল নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাও ছিল। লুইস পাস্তুরসহ তখনকার সকলেরই ধারনা ছিল যে মদ্য তৈরির প্রক্রিয়া ফার্মান্টেশন একটি রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং এতে কোনো প্রকার জীবিত যৌগের ব্যবহার হতো না। এছাড়াও তখনো বিজ্ঞানীরা জৌব যৌগের গবেষনায় তেমন অগ্রগতি করতে সক্ষম হয়নি।

সমস্যা সমাধানে লুইস পাস্তুর মসিউর বিগো নামক একজন স্থানীয় ওয়াইন প্রস্তুতকারকের সরনাপন্ন হন। পাস্তুর বিগোর ফ্যাক্টরিতে গিয়ে নষ্ট ওয়াইন পরীক্ষা শুরু করে। কিন্তু অন্যন্য রসায়নবিদের মত না করে তিনি বরং গ্লাস থেকে ওয়াইনের ফোঁটা নিয়ে মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে পরীক্ষা শুরু করে। যা আগে কখনো করা হয়নি। মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করে তিনি হতবাক হন।

পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জীবিত এবং মৃত বস্তুর তফাত জানতান। মাইক্রোস্কোপে পরীক্ষা করে তিনিই প্রথম ওয়াইনের ইস্টে জীবিত বস্তুর সন্ধান পান। পরীক্ষা থেকে তিনি বুঝতে পারেন এই অতিক্ষুদ্র জীবিত বস্তুই ওয়াইন নষ্ট হওয়ার পিছনে দায়ী। তিনি এই জীবিত বস্তুর নাম রাখেন জার্ম বা ব্যাক্টেরিয়া।

১৮৫৭ সালে তিনি ‘জার্ম থিওরি অফ ফার্মেন্টেশন’ নামক একটি সাইন্টেফিক পেপার প্রকাশ করেন। ইতিহাসে এই প্রথম ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করা শুরু হয়। এই পেপাররই পরবর্তীতে মাইক্রোবায়লোজির ভিত স্থাপনা করেন এবং মাইক্রোবায়লোজি বা অতিক্ষুদ্র জীবানু নিয়ে গবেষনা শুরু হয়।

১৮৬৩ সালে পাস্তুর ওয়াইন নষ্ট হওয়ার জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াগুলো শনাক্ত করে। এছাড়াও তিনি অন্যান্য দ্রব্য যেমন দুধ, পনির, বিয়ার এসকল পদার্থ নিয়েও গবেষনা করে এবং এসকল পদার্থের ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া শনাক্ত ও ধ্বংস করার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করে। যা রসায়নেপাস্তুরাইজেশন নামে পরিচিত। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি শুধুমাত্র ফ্রান্সের অর্থনীতিই রক্ষা করেনি বরং পচনশীল দ্রব্য রক্ষা করার পদ্ধতিও শুরু করেন।

লুইস পাস্তুরের গবেষণা নস্ট ওয়াইন দিয়ে শুরু হলেও তিনি পরবর্তীতে মানুষের জন্য ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া শনাক্ত করতে কাজ শুরু করে। পাস্তুর শুধুমাত্র এসকল ব্যাক্টেরিয়া শনাক্ত করেই ক্ষান্ত হননি বরং এই ব্যাক্টেরিয়াগুলো ধ্বংস করার উপায়ও তৈরি করেন। তার মাধ্যমেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রথম প্রতিষেধক বা কোনো রোগকে পুরোপুরিভাবে নির্মূল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পাস্তুর পরবর্তীতে গুটি বসন্ত, চিকেন কলেরা, এনথ্রাক্স এবং র‍্যাবিসের মত মহামারী রোগের ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করেন।

এসকল ভ্যাক্সিন মানব সভ্যতাকেই শুধু এই মহামারী রোগগুলো থেকে শুধু রক্ষা করেনি বরং পৃথিবী থেকে এসকল রোগকে পুরোপুরিভাবে নির্মূল ও করে। এভাবেই নষ্ট ওয়াইন থেকে শুরু করা গবেষণা মানবসভ্যতাকে রক্ষা করে ভয়ঙ্কর সব রোগের কবল থেকে বাঁচিয়েছে।

আরএম-০২/১৬/০৬ (স্বাস্থ্য ডেস্ক)