মূত্রনালীর সংক্রমণ: লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার

মূত্রনালীর

প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করছে? প্রস্রাবের বেগ ধরে রাখতে পারছেন না? বারবার প্রস্রাব হচ্ছে? অথবা প্রস্রাবের চাপ থাকা সত্ত্বেও ঠিকমতো হচ্ছে না? আপনি যদি একজন নারী হন, তাহলে এ ধরনের সমস্যায় শতভাগ নিশ্চিত হতে পারেন আপনি মূত্রনালীর সংক্রমণ বা ইউটিআই (UTI) এ ভুগছেন।

পুরুষরা এ সমস্যায় পড়েন না তা নয়, তবে নারীদের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা বেশি। আর বিশ্বব্যাপী এ সমস্যা এখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তাই এখনই সময় সচেতন হবার।

মূত্রনালীতে সংক্রমণ বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (ইউটিআই) সবসময়ই অতর্কিতে হানা দেয়। অনেকেই আছেন যারা ইউটিআই-তে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে নিজেরাই বাজারচলতি কিছু ওষুধ ও জেল ব্যবহার করতে শুরু করেন। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা করা ঠিক নয়। এতে সংক্রমণ না কমে বরং শরীরে লুকিয়ে থাকে। ওষুধ বন্ধ করার কিছুদিন পর আরও প্রবল আকারে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই প্রথম থেকেই এই অসুখে সচেতন হতে হবে।

মূত্রনালীর সংক্রমণ রোগের লক্ষণ রোগীর বয়স এবং লিঙ্গের উপর নির্ভর করে ভিন্ন রকম হতে পারে।

তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ আছে। যেমন:

১. ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ আসা, কিন্তু কোনবারই যথেষ্ট পরিমাণ প্রস্রাব হবে না।

২. প্রস্রাব করার সময় তীব্র ব্যথা এবং জ্বালাপোড়া অনুভব হবে।

৩. শরীর দুর্বল হওয়া, পিঠের নিচের দিকে বা তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হওয়া।

৪. ঘোলা ও দূর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব হওয়া বা কখনো কখনো প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া।

৫. প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া ভাবের সাথে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে।

৬. প্রস্রাব আটকে রাখতে না পারা।

৭. ছোটদের ক্ষেত্রে ডায়ারিয়া, জ্বর, খেতে না চাওয়া ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা যায়।

এসব উপসর্গ দেখলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

ইউটিআই কেন হয়:

ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে এই সমস্যা অনেক বেশি দেখা যায়। কারণ মেয়েদের মূত্রনালী জন্মগতভাবে পুরুষদের তুলনায় ছোট এবং মলদ্বারের খুব কাছাকাছি। তাই ব্যাকটেরিয়া খুব সহজেই আক্রমণ করে এবং জীবাণু মূত্রথলি এবং কিডনির উপর প্রভাব বিস্তার করে।

১. ইস্ট্রোজেন মূত্রনালির সংক্রমণে বাধা দেয়। মেনোপজ-এর পর ইস্ট্রোজেন-এর ক্ষরণ কমে যায়। ফলে সংক্রমণের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়।

২. অনেকক্ষণ প্রস্রাব আটকিয়ে রাখলে সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। টেলিভিশন দেখার সময়, বাসে ট্রেনে যাতায়াত করার সময় বা জরুরী মিটিং-এর সময় অনেকেই প্রস্রাব আটকিয়ে রাখেন যা একদমই উচিত নয়।

৩. যৌনসঙ্গীর ইউটিআই থাকলে শারীরিক মিলনের সময় অন্য সঙ্গীও সংক্রমিত হতে পারেন।

৪. পারসোনাল হাইজিন বা নিজস্ব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে না চললে ইউটিআই হতে পারে।

৫. যদি কারো কিডনি অথবা মুত্রথলিতে পাথর থাকে তবে তা স্বাভাবিক মূত্রত্যাগে বাধা প্রদান করে। এর ফলেও ইনফেকশন হতে পারে।

৬. ডায়াবেটিস, প্রেগন্যান্সি বা অন্য কোন রোগে যদি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে থাকে তাহলে ইউটিআই হতে পারে।

৭. অনেক সময় অপারেশনের আগে বা পরে রোগীদের ক্যাথেটার পড়ানো হয়। বেশিদিন ক্যাথেটার পরানো থাকলে খুব সহজেই ইউটিআই হতে পারে।

ইউটিআই-এর ফলে ঝুঁকি :

১. সঠিক সময়ে ঠিকমত চিকিৎসা না করালে একই সমস্যা বারবার হতে পারে।

২. মুত্রনালি থেকে ইনফেকশন কিডনি পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে।

৩. বারবার হলে কিডনি ঠিকমত কাজ করে না। যেখান থেকে পাইলোনেফ্রাইটিস-এর মতো জটিল সমস্যা দেখা দেয়।

৪. গর্ভাবস্থায় ইউটিআই হলে সময়ের আগেই ডেলিভারি হয়ে যাওয়া, কম ওজনের বাচ্চা জন্ম দেয়া, এমনকি গর্ভপাত পর্যন্ত হতে পারে।

৫. অনেক সময় ইনফেকশনের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে তা রক্তে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

দেখে নিন কী উপায়ে এই অসুখ থেকে দূরে থাকা যায়:

১. নিয়ম মেনে শরীরে যতটা পানির প্রয়োজন, ততটাই পানি খেতে হবে। যত বেশিবার মূত্র নির্গত হবে, ততই শরীর থেকে টক্সিন বার হবে। এতে মূত্রথলিতে জীবাণুর বাসা বাঁধার শঙ্কাও কমে।

২. পানির পাশাপাশি তরল খাবার যেমন ফলের জুস, ডাবের পানি ইত্যাদি বেশি বেশি পান করুন।

২. পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের সময় খেয়াল রাখবেন সেটি পরিষ্কার কিনা। হাই কমোড ব্যবহারের সময় সেটা পানি দিয়ে ধুয়ে নিবেন, যদি সম্ভব না হয় তাহলে কমোডের উপর টিস্যু পেপার বিছিয়ে নেবেন এতে করে জীবাণু সহজে আপনার শরীরের সংস্পর্শে আসতে পারবে না।

৩. একই কাপড় না ধুয়ে বেশিদিন পরিধান করা থেকে বিরত থাকুন। প্যান্টি নিয়মিত ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। কারণ অনেকদিন যাবত না ধুয়ে ব্যাবহার করলে তাতে জীবাণু বাসা বাধে এবং সংক্রমণ করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

৪. প্রতিদিন দু’বেলা চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে বিশেষ কোনও জেল বা সাবান দিয়ে গোপনাঙ্গ পরিষ্কার করুন।

৫. প্রস্রাবের পর যৌনাঙ্গ ভালো করে ধুয়ে নিন। মনে রাখবেন, যৌনাঙ্গ পরিষ্কার করার সময় সবসময় সামনে দিক থেকে পেছনে যাবেন, পেছন থেকে সামনে নয়। তা না হলে মলদ্বার থেকে জীবাণু সামনে চলে এসে সংক্রমণের ভয় থাকে।

৬. যখনই প্রস্রাবের বেগ আসবে সাথে সাথে প্রস্রাব করে ফেলুন, আটকিয়ে রাখবেন না।

৭. সহবাসের পরে অবশ্যই বাথরুমে যান। ব্লাডার খালি করে দেওয়াই ভালো। কেননা ইন্টারকোর্সের সময় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। সেখান থেকে বিভিন্ন ইনফেকশন হতে পারে। এছাড়াও সেক্সের সময় ব্যবহৃত গর্ভনিরোধ থেকেও সংক্রমণ হতে পারে।

৮. সর্বপোরি পার্সোনাল হাইজিন বা ব্যক্তি জীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

একবার ইউটিআই হয়ে গেলে অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া উপায় থাকে না। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে রোগীক সুস্থ করে তোলে। তবে, ওষুধ খাওয়ার আগে পরিপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ীই খাওয়া উচিত।

মনে রাখবেন, এই রোগটি সম্পূর্ণ ব্যক্তি জীবনের লাইফস্টাইলের উপর নির্ভরশীল। এতে প্রথম দিকে তেমন কোন সমস্যা না হলেও বারবার হতেই থাকলে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে যে কারো জীবনে। তাই সময় থাকতেই নিজের যত্নে সচেতন হন।

আরএম-১৭/১৪/১১ (স্বাস্থ্য ডেস্ক)