নকল ওষুধ বুঝবেন কিভাবে? জেনে নিন বোঝার সহজ উপায়

নকল ওষুধ

ওষুধ উদ্ভাবনের সময় দীর্ঘকাল ধরে অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা নির্ধারণ করেন কোন ওষুধে রোগ সারানোর জন্য কী পরিমাণে সক্রিয় উপাদান থাকতে হবে। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেটে সক্রিয় উপাদান হিসেবে প্যারাসিটামল থাকে ৫০০ মিলিগ্রাম।

সক্রিয় উপাদানের সঙ্গে আয়তন বাড়ানোর জন্য স্টার্চ, ল্যাকটোজ বা অন্যান্য নিষ্ক্রিয় উপাদান যোগ করাসহ ট্যাবলেটের আকার-আকৃতি প্রদানের জন্য অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে ওষুধের পরিপূর্ণ রূপ প্রদান করা হয়। অনেক সময় সক্রিয় উপাদানের পরিমাণ এত কম থাকে যে, (যেমন ১ মিলিগ্রাম) তা দিয়ে ওষুধের আকার-আকৃতি প্রদান করা যায় না। তাই নিষ্ক্রিয় উপকরণ মিশিয়ে আয়তন বাড়িয়ে ওষুধ তৈরি করা হয়।

ওষুধে সক্রিয় উপাদান না থাকলে তাকে ওষুধ বলা যাবে না। প্যারাসিটামল ব্যবহার না করেই শুধু স্টার্চ বা অন্যান্য উপকরণ দিয়ে এমন ট্যাবলেট তৈরি করা যায়, যা দেখলে মনে হবে হুবহু একটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট। সক্রিয় উপাদান না থাকার কারণে এমন ওষুধ খেলে ব্যথা-বেদনা বা জ্বর সারবে না। তাই এসব ওষুধকে বলা হয় নকল ওষুধ।

সামান্য ব্যথা-বেদনা বা জ্বর সারানোর জন্য নকল প্যারাসিটামল ব্যবহারের কারণে রোগ না সারলেও তা কারও জীবনের জন্য বিপজ্জনক না-ও হতে পারে, যদিও তা অস্বস্তিকর ও যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। কিন্তু এমন সব রোগ আছে যে ক্ষেত্রে ওষুধ সঠিক মাত্রায় সেবন না করলে রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে এবং একসময় রোগী মারাও যেতে পারে। সংক্রামক রোগের কথাই ধরা যাক।

সংক্রামক রোগের প্রতিকারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার অপরিহার্য। শরীর বা শরীরের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে শরীর ও জীবাণুর মধ্যে টিকে থাকার জন্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে শরীর তার প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্বারা বা অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য জীবাণু ধ্বংস করার কাজ চালিয়ে যায়। শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল বা নষ্ট হয়ে গেলে এবং কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক সেবন না করা হলে জীবাণু শরীর ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু করে। এর অর্থ হল- স্বাস্থ্যের ক্ষতি এবং পরবর্তী সময়ে অবধারিত মৃত্যু।

নকল, ভেজাল ও নিন্মমানের অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে কার্যকারিতা না পেয়ে চিকিৎসক বা রোগী একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক পরিবর্তন করতে থাকে।

এভাবে নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে জীবাণু ওষুধের কার্যকারিতাকে নিষ্ফল করে দিয়ে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে শরীরে বহাল তবিয়তে টিকে থাকতে পারে। অন্যদিকে বেশি পরিমাণে সক্রিয় উপাদান থাকলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, বিষক্রিয়ায় রোগীর অবস্থার অবনতি হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে রোগী মারাও যেতে পারে।

আসল ওষুধের নামে ও অবয়বে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রতারণামূলকভাবে নকল উপকরণ দিয়ে, না দিয়ে বা ভেজাল দিয়ে উৎপাদিত ওষুধকে নকল ওষুধ বলে। ব্র্যান্ড ওষুধের মতো জেনেরিক ওষুধও নকল হয়। অনেক ওষুধে ঠিক উপকরণটি ব্যবহার করা হলেও তা পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে না। এসব ওষুধকে নিন্মমানের ওষুধ বলা হয়।

সম্প্রতি ল্যানসেট প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে জানা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক-তৃতীয়াংশ ম্যালেরিয়ার ওষুধ নকল। গবেষকরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাতটি দেশে পাঁচ ধরনের ১৪৩৭টি ম্যালেরিয়ার ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করে দেখতে পান, এসব ওষুধের ৩৬ শতাংশ নকল। এসব নমুনার মধ্যে ৩০ শতাংশ ওষুধে কোনো উপকরণই নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১০ সালে সারা বিশ্বে ম্যালেরিয়ায় ৬ লাখ ৫৫ হাজার মানুষ মারা যায়। নকল, ভেজাল ও নিন্মমানের ওষুধ এসব মৃত্যুর জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী বলে মনে করা হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এসব নকল, ভেজাল ও নিন্মমানের ওষুধের মধ্যে অধিকাংশ হল অ্যার্টেমিসিনিন ও অ্যার্টেমিসিনিন থেকে রাসায়নিকভাবে উদ্ভাবিত অন্যান্য ওষুধ।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ সমস্যার কারণ মূলত বহুবিধ। ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিকারে ওষুধের নির্বিচার ব্যবহার, ম্যালেরিয়ার ওষুধের যথাযথ গুণগতমান নিশ্চিতকরণে ব্যর্থতা এবং অসাধু নকলবাজ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানে অনীহা ও ব্যর্থতা উল্লিখিত সমস্যার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গত দশকে ম্যালেরিয়া নির্মূলে যে অভাবনীয় বিনিয়োগ ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছিল- নকল, ভেজাল ও নিন্মমানের ম্যালেরিয়ার ওষুধের কারণে তা ভেস্তে যেতে বসেছে।

হাইপারটেনশন বা উচ্চরক্তচাপকে ‘সাইলেন্ট কিলার’ বা নীরব ঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর লাখ লাখ লোক উচ্চরক্তচাপে মৃত্যুবরণ করে। উচ্চরক্তচাপের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দুটো প্রাণঘাতী রোগ হল হৃদরোগ ও স্ট্রোক। হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত মানুষ অকর্মণ্য হয়ে যায় বা মৃত্যুবরণ করে।

প্রাকৃতিক উপায়ে অথবা লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব না হলে রোগীকে ওষুধ গ্রহণ করতে হয়। ওষুধ যদি আসল ও গুণগতমানসম্পন্ন হয় তবে রোগী ওষুধ সেবন করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে।

আর ওষুধ যদি নকল, ভেজাল ও নিন্মমানের হয় তবে রোগীর কী অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখুন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, সারা বিশ্বে, বিশেষ করে অনুন্নত দেশগুলোয় রক্তচাপের অসংখ্য ওষুধ নকল হচ্ছে এবং ওষুধ সেবন করে অগণিত মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও জীবন দিচ্ছে। ক্যান্সার প্রাণঘাতী রোগ।

এ রোগ প্রতিকারে এখনও খুব বেশি কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। আর যেসব ওষুধ বাজারে প্রচলিত আছে সেগুলোর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। অ্যাভাস্টিন একটি বহুল প্রচলিত ক্যান্সারের ওষুধ। অ্যাভাস্টিনের একটিমাত্র ভায়ালের দাম আড়াই হাজার ডলার ( প্রায় ২ লাখ ৫ হাজার টাকা)। গত বছর মোট ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের এ ওষুধ বিক্রি হয়েছে।

ওষুধ নকলের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে শাস্তি হল জেল। নকল ওষুধ প্রস্তুতকারকরা খুব অল্প সময়ে কয়েক মিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে ফেলতে পারে এবং তারা ধরা পড়লে খুব বেশি হলে ৬ মাসের মতো জেলে থাকতে হয়। নকল ওষুধের জন্য ব্যবসায়ীদের যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য জিনিসের জন্য মাত্র ৫০ হাজার টাকার মতো খরচ করতে হয়। অল্প খরচে এটা তো অনেক লাভজনক ব্যবসা।

এক সংবাদে জানা যায়, অসাধু নকলবাজ ব্যবসায়ীরা অ্যাভেস্টিনের নকল ভার্সন উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে মাল্টিমিলিয়ন ডলারের লাভজনক ব্যবসাটি হাতিয়ে নিয়েছে। নকল অ্যাভেস্টিন এখন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে যার কারণে ক্যান্সারের রোগীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা ওসব ওষুধ বেশি নকল করে যেগুলো বিক্রির দিক থেকে শীর্ষস্থানীয় ও দাম বেশি। ফাইজারের কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ লিপিটর (জেনেরিক : অ্যাটরভ্যাস্টেটিন) বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্লকবাস্টার ওষুধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও লিপিটরের নকল পাওয়া যায়।

২০০৭-০৮ সালে নকল হেপারিনের (যে ওষুধ রক্তজমাট প্রতিহত করে) ব্যবহারের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ১৪৯ লোক মৃত্যুবরণ করে। এ নকল হেপারিন চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিল।

পরিসংখ্যান মোতাবেক বিশ্বের ১৫ শতাংশ ওষুধ নকল। এশিয়া ও আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে নকল ওষুধের পরিমাণ ৫০ শতাংশ। অ্যাঙ্গোলায় নকল ওষুধের পরিমাণ মোট ওষুধের ৭০ শতাংশ।

২০০৫ সালে ওইসিডি (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের) হিসাবমতে, সারা বিশ্বে নকল ওষুধের বিক্রীত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার। নকল ওষুধ উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলো হল- পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, ল্যাতিন আমেরিকা, পূর্ব মধ্য ইউরোপের অনেক দেশ, আফ্রিকা এবং ভূতপূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন। এসব দেশে বেশি নকল, ভেজাল ও নিন্মমানের ওষুধ উৎপাদিত হয় যেসব দেশে ওষুধ শিল্পে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত শিথিল এবং আইনগত বাধ্যবাধকতার অভাব রয়েছে।

অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার ও নীতিনির্ধারকদের দুর্নীতির কারণে নকল, ভেজাল ও নিন্মমানের ওষুধ ও পণ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, নিউজিল্যান্ড, পশ্চিম ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোয় নকল, ভেজাল ও নিন্মমানের ওষুধের পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। কারণ এসব দেশে ওষুধ এবং ওষুধ শিল্পের ওপর সরকারের কঠোর আইন ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত আছে। চীনে ওষুধ ও খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল এবং নকলের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করার বিধান আছে।

তারপরও সে দেশে ব্যাপকহারে ওষুধ নকল হয়। ওষুধের অনলাইন বেচাকেনা বিশ্বজুড়ে নকল ওষুধের ব্যবসাকে সম্প্রসারিত করেছে। ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব বোর্ড অব ফার্মেসির মতে, ৯ হাজার ৬০০ অনলাইন ফার্মেসির মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ কোম্পানির গুণগতমানের শর্ত পূর্ণ করে। এসব ফার্মেসির বেশকটিই বিদেশি বলে এদের ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করা অবৈধ। অনেক ওষুধের জন্য আবার প্রেসক্রিপশন লাগে না। এ সুযোগে অসংখ্য নকল ও ভেজাল ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে যায়। আমি উপরে উল্লেখ করেছি, বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ কীভাবে নকল ওষুধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং জীবন দিচ্ছে।

এ ছাড়া ওষুধ কোম্পানিগুলো প্রতিবছর নকল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের কারণে কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ প্রতিরোধে স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলো হল- ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, পেশেন্ট অ্যাডভোকেসি গ্রুপ, ওষুধ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গবেষক, প্রস্তুতকারক, সিকিউরিটি কোম্পানি, লাইসেন্সপ্রাপ্ত অনলাইন ফার্মেসি। ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে ইউরোপীয় ট্রেড কমিশন অ্যান্টি-কাউন্টারফিটিং ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (নকলবিরোধী বাণিজ্য চুক্তি) সম্পাদনের কাজ সম্পন্ন করেছে।

চুক্তিতে পেটেন্ট রুল সংরক্ষণ, নকল ওষুধ বিক্রয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এ সমস্যা সমাধানে বৃহত্তর সহযোগিতার দ্বার উন্মোচন করার বিধান রাখা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কোরিয়া, মেক্সিকো, মরক্কো, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তি সম্পাদনে অংশগ্রহণ করে।

এ চুক্তি বাস্তবায়িত হলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নকল ওষুধের দৌরাত্ম্য বহুলাংশে কমে যাবে। তবে নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ প্রতিরোধ এত সহজ হবে না, বিশেষ করে অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোয়। কারণ এসব দেশে মাথাপিছু আয় নগণ্য হওয়ার কারণে দামি ওষুধ কেনার সামর্থ্য না থাকায় মানুষ সস্তায় ওষুধ পেতে চায়। ওষুধের দাম বেশি হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল ওষুধ উৎপাদনে ও বিক্রয়ে বেশি উৎসাহী হয় । এ ফর্মুলা ওষুধ কোম্পানিগুলোর ক্ষতির পরিমাণ বাড়ায়।

বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে অসংখ্য ওষুধের দাম দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সুযোগটি দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীরা গ্রহণ করবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। বেশ কিছুদিন আগে যুগান্তরে ‘মিটফোর্ডেও অবৈধ মার্কেটে কাঁচামালের জোগান দিচ্ছে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন পড়েছিলাম।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ওষুধ উৎপাদনের নাম করে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি কাঁচামাল কিনে নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল, ভেজাল ও নিন্মমানের ওষুধ উৎপাদন করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের নাকের ডগায় বছরের পর বছর ধরে খোলাবাজারে কাঁচামাল বিক্রি হয়ে এলেও রহস্যজনক কারণে তারা এ অবৈধ বেচাকেনা বন্ধ করে না।

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কারিগরি উন্নয়নের ফলে আজকাল আসল আর নকল ওষুধের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শুধু জানা যায়, কোনটা আসল আর কোনটা নকল ওষুধ। তারপরও কিছু চিহ্ন আর বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে নকল ওষুধ চেনা যায়। নকল ওষুধের অদ্ভুত ধরনের গন্ধ, স্বাদ ও রং থাকে। নকল ওষুধ অতিসহজে ভেঙে গুড়া হয়ে যায় বা টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ওষুধের প্যাকেটের গুণগতমান তেমন ভালো হয় না। লেবেলে নির্দেশনায় ভুল বানানের শব্দ থাকে এবং নির্দেশনায়ও ভুল থাকতে পারে। নকল ওষুধের দাম অত্যন্ত কম হয়। আসল ওষুধের দামের সঙ্গে তুলনা করলে একই নকল ওষুধের দামের তারতম্য ওষুধের গুণগতমান সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে।

সম্ভবত গত বছরের ১০ মে দেশে ভেজাল ও নকল ওষুধ উৎপাদন এবং বাজারতাজকরণ রোধে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নেতৃত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী, স্বাস্থ্য সচিব, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক ও ওষুধ শিল্প সমিতির নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।

এ সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী যে কোনো মূল্যে নকল এবং ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধে সরকার ও ওষুধ কোম্পানিগুলোকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ওষুধ হচ্ছে মানুষকে বাঁচানোর একটি মাধ্যম। আর সেই ওষুধ নকল ও ভেজাল করে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। বৈঠকে বেশকিছু পদক্ষেপের বিষয়ে আলোচনা হয়; কিন্তু পদক্ষেপগুলো কী তা জানা যায়নি।

বেশ কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘ভেজাল ও নকল ওষুধের ছড়াছড়ি’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। একইদিন অন্য একটি জাতীয় দৈনিকে ‘ভিটামিনে মরণফাঁদ’ শীর্ষক আরেকটি প্রতিবেদন পড়েছিলাম।

দুটো প্রতিবেদনেই নকল ও ভেজাল ওষুধ সম্পর্কে যেসব চাঞ্চল্যকর তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে, তা পড়ে আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে ইলেকট্রুনিক মিডিয়া ও পত্রিকাগুলো নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তসহ হরেক রকম প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। দিন দিন যেন নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ প্রস্তুতকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে, আর তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের নিরাপত্তাহীনতা। একটি ব্যাপার লক্ষণীয়।

অনেক ক্ষেত্রে নকল, ভেজাল ওষুধ ধরা পড়ছে, দুর্নীতিবাজ এবং দুষ্কৃতকারীরাও আটক হচ্ছে। ১৯৪০ সালের ড্রাগ অ্যাক্টের আওতায় নগণ্য শাস্তিও দেয়া হচ্ছে। অপরাধের তুলনায় শাস্তির মাত্রা এতই কম যে, তাতে অপরাধ এবং অপরাধীর ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না। নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ উৎপাদন এবং বিক্রি করার মাধ্যমে মানুষ হত্যার শাস্তি এক বা দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক, দুই বা তিন মাস জেল গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে আইন-কানুন পরিবর্তন করে আরও কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে, যাতে আর কেউ কোনো সময় নকল ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করার সাহস না পায়।

আরএম-১৭/১৬/১১ (স্বাস্থ্য ডেস্ক)