অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশি

অ্যান্টিবায়োটিকের

অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা বিজ্ঞানকে বেশ উন্নতির দিকে নিয়ে গেলেও আদতে কতটুকু উন্নতি হয়েছে তা ভাবার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যতম আশীর্বাদ হলো অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার। এর ফলে এমন অনেক রোগের চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে, যেগুলোর কারণে এক সময় মানুষ মারা যেত। তবে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সেবনে ক্ষতির কারণ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা ঠিক নয়। প্রিসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসিতে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বাংলাদেশে। কিন্তু অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খান ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই। আবার অনেকে নির্দিষ্ট কোর্স শেষ করেন না।

অ্যান্টিবায়োটিকের অপর নাম অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ড্রাগ। এগুলো হলো এমন এক ধরনের ওষুধ যা মানুষ এবং পশু উভয়ের শরীরেই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এক্ষেত্রে তারা হয় ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলে, নয়তো ব্যাকটেরিয়ার দৈহিক বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার রোধ করে। তবে অ্যান্টিবায়োটিক কেবল নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়াঘটিত ইনফেকশনই প্রতিরোধ করে। ভাইরাসের উপর এরা কোনও প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলো এমন একটি অবস্থা যা সংগঠিত হয়, যখন কতিপয় ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের আক্রমণ থেকে বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে। এসব ব্যাকটেরিয়াকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া। এরা অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতে অভিযোজিত হয়ে যায় বলে, নিজেদের স্বাভাবিক গতিতে বেড়ে উঠতে ও বংশবিস্তার করতে পারে। ফলে মানুষ বা পশুর শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। আগে যে অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে তাদের রোগ সেরে যেত, এখন আর সেই অ্যান্টিবায়োটিকে তা সারে না, বরং ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং এসব রোগাক্রান্ত মানুষ বা পশু অন্য কারও উপস্থিতিতে হাঁচি-কাশি প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দেয়, এবং তারাও একই রকম দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়।

হলি ফ্যামিলি কলেজ এবং হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা.মোহাম্মদ জাকারিয়া জানান, সাধারণত ভাইরাল ইনফেকশন যেমন সর্দি,কাশি জ্বর এসবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাবহার করা উচিত নয়। তবে যদি ইনফেকশন বা সংক্রমণ দ্বিতীয় পর্যায়ে যায় তখন দেয়া যেতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিকের মূল লক্ষ্য থাকে রোগের জীবাণু একদম মেরে ফেলা। চিকিৎসক একজন রোগীর অবস্থা বুঝে ৫ থেকে ৭ দিনের একটা কোর্স দিয়ে থাকেন। কিন্তু কেউ যদি সেই সময়ের আগে, ধরেন দুই দিন খেয়ে আর খেল না, তখন যেটা হয়, ঐ অ্যান্টিবায়োটিক রোগীর শরীরে অকার্যকর হয়ে পড়ে। তখন ওই রোগীর জন্য আগের চেয়ে বেশি মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দরকার হয়ে পরে।

মানুষের শরীরের অ্যান্টিবায়োটিকের অতি ব্যবহার বা কোর্স শেষ না করার ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে দিতে।

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যায়। বাতাসে নানা ধরণের জীবাণু, ভাইরাস থাকে। সেগুলো প্রতিরোধ করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পরে। যেকোন রোগে সহজেই আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যায়।

তিনি বলেন, ‘সাধারণত খুব সিরিয়াস অবস্থা না হলে চিকিৎসকদের অ্যান্টিবায়োটিকের নির্দেশনা দেয়া ঠিক না।’

অসুখ থেকে মুক্তি পেতে আমরা দ্বারস্থ হই অ্যান্টিবায়োটিকের। নানা ব্যথা-বেদনা দূর করতে এর বিকল্প নেই বলতে গেলে। কিন্তু সমস্যা হলো এই অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া নিয়ে। কখনও খাওয়া হয় চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে, কখনোবা নিজেই চিকিৎসক বনে যাই। নিজেরাই খেয়ে ফেলি মুঠো মুঠো অ্যান্টিবায়োটিক।

অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করলেও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশি। বিভিন্ন রকমের অ্যান্টিবায়োটিক বিভিন্ন রকম কাজ করে-

১. নিউমোনিয়া কমাতে সাধারণত চিকিৎসকরা দেন ক্যুইনোলোনস। এই কম্পোজিশন মেলে লেভোফ্লক্সাসিন আর সিপ্রোফ্লক্সাসিনে।

২. পেনিসিলিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক কোষের গায়ে লেগে থাকা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে।

৩. এরিথ্রোমাইসিনে থাকে ম্যাক্রোলাইড অ্যান্টিবায়োটিক। এরা কোষের মধ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়া রাইবোসোমকে আক্রমণ করে। এবং ত্বকের বিভিন্ন সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে।

শরীরের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া মেরে আপনাকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সমস্ত ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণেই সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। তবে সবটাই পর্যাপ্ত পরিমাণ।

ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটি: একসঙ্গে অনেক ব্যাকটিরিয়া সংক্রমণ ছড়ালে ব্যবহৃত হয়। লিমিটেড স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটি: কেবলমাত্র নির্দিষ্ট ব্যাকটিরিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে ব্যবহৃত হয়। আপনার কোন রোগে কী ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক নেবেন তা ঠিক করবেন চিকিৎসক।

অ্যান্টিবায়োটিকের সাহায্যে সাধারণ এই রোগগুলো কমে:

১. ত্বকের সংক্রমণ।

২. নিউমোনিয়া।

৩. কিডনি বা অন্ত্রের সংক্রমণ।

৪. সাইনাস সংক্রমণ।

৫. কানে সংক্রমণ।

৬. মেনিনজাইটিস।

৭. দাঁতের সংক্রমণ।

অ্যান্টিবায়োটিকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া:

অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ক্ষতিকারক জীবাণু নষ্ট করার পাশাপাশি আপনার শরীরের ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলোকেও নষ্ট করে দেয়। এতে ক্ষতিকারক ব্যাকটিরিয়ার সংখ্যা বাড়ে। অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে আপনার শরীরে বিপরীত প্রভাব পড়তে পারে।

১. ডায়রিয়াল সংক্রমণ।

২. বমি বমি ভাব।

৩. পেটে ব্যথা।

৪. পেশিতে টান বা ব্যথা।

৫. মলের সঙ্গে রক্তপাত।

অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার করে অসংখ্য মানুষ দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সামান্য প্রয়োজনে কিংবা প্রয়োজন ছাড়াই চিকিৎসকের পরামর্শ এড়িয়ে নিজেরাই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছেন রোগী। ফলে অ্যান্টিবায়োটিকের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশে ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক অপব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, অনেক ডাক্তার রোগীর অনুরোধেও প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেন। কিন্তু অনেক রোগী তা নির্ধারিত সময় ধরে ব্যবহার করেন না। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চিকিৎসকের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিকের ফুল কোর্স সম্পন্ন করতে হবে।

দেশে ওষুধের দোকানের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার। এসব দোকান থেকে প্রতিদিন অন্তত ১০ লাখ অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই বিক্রি হচ্ছে। দেশের হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বেড়েছে বলে এক গবেষণা উঠে এসেছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর শিশু বিভাগে ৯৬ শতাংশ রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেওয়া হয়। মেডিসিন বিভাগের ৫৪ শতাংশ রোগী এবং ৮১ শতাংশ সার্জারি রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। এ ছাড়া চিকিৎকেরা নিজস্ব চেম্বারে প্রায় ৫০ শতাংশ রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দেন। এমনকি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে আসা ২৫ শতাংশ রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের পরামর্শ দেওয়া হয় বলে ঐ গবেষণা উঠে এসেছে।

অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ক্ষতিকর। অ্যান্টিবায়োটিক ঠাণ্ডা বা ভাইরাসজনিত রোগে কোনো কাজ করে না। অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা খুবই জরুরি। অ্যান্টিবায়োটিক যেমন- সিপ্রোফ্লক্সাসিন, লিভোফ্লক্সাসিন এবং টেট্রাসাইক্লিন ভালোভাবে কাজ করে না যদি একই সময় এ জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে ক্যালসিয়াম, আয়রন বা এন্টাসিড প্রদান করা হয়।

এ জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক চলাকালীন দুধ, পনির এবং বাদাম জাতীয় খাবার খাওয়া উচিত নয়। কখনও কখনও অ্যান্টিবায়োটিক যেমন ইরাইথ্রোমাইসিন বা সিপ্রোফ্লক্সাসিন সেবনের কারণে অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন বা রক্তচাপ হ্রাস পেতে পারে।

কিছু অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কারণে মুখের অভ্যন্তরে লাইকেনয়েড রিঅ্যাকশন হয়ে থাকে যা দেখতে মুখের রোগ লাইকেন প্ল্যানাসের মতো। তাই মুখের অভ্যন্তরে কোনো আলসার বা ঘাঁ, সাদা দাগ, লেসি স্ট্রাই দেখলে রোগ নির্ণয়ের আগে রোগীর সার্বিক ইতিহাস জানা জরুরি। সব রোগীদের সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান করা যায় না। অন্য কোনো রোগ না থাকলে একজন মানুষকে কোনো রোগের জন্য যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রদান করা হয়, একই রোগের জন্য অন্য একজন মানুষকে ঐ অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া যাবে না যদি রোগী কোনো জটিল কিডনি, লিভার বা অন্য আরেকটি রোগে আক্রান্ত থাকেন।

আরএম-১৬/১৯/১১ (স্বাস্থ্য ডেস্ক)