পুরুষ জনন অঙ্গের যত সমস্যা

পুরুষ জনন

পুরুষ জনন অঙ্গের রয়েছে নানা ধরনের সমস্যা। এর অন্যতম হলো, উত্থিত না হওয়া। কোনো ব্যক্তির নিজের বা তার স্ত্রীর যৌন চাহিদা পূরণের উপযোগী পুরুষ জনন অঙ্গের উত্থানের ও তা বজায় রাখার অক্ষমতাই হলো পুরুষের জনন অঙ্গের উত্থানজনিত সমস্যা। বেশির ভাগ পুরুষেরই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এই অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত এটা মানসিক পীড়নের কারণ হয়ে দেখা দেয়। কোনো কোনো পুরুষ দীর্ঘমেয়াদি পূর্ণাঙ্গ সমস্যায় আক্রান্ত হন আবার কেউ কেউ আংশিক বা ক্ষণস্থায়ী সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। ঘনঘন এ রকম আক্রান্ত হলে মানসিক পীড়া, সম্পর্ক নষ্ট হওয়া এবং আত্মযর্মাদাহীনতার মতো সমস্যা হয়। নানা কারণে এ সমস্যা হতে পারে। এর বেশিরভাগই চিকিৎসাযোগ্য।

রোগটির ব্যাপকতা :

এ রোগের ব্যাপকতা নিয়ে বাংলাদেশের কোনো সমীক্ষা না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের সমীক্ষায় অবস্থা তা জেনে নিতে পারি।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনসিটিটিউটের সূত্র অনুসারে ২০০২ সালে ১৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ আমেরিকান পুরুষ জনন অঙ্গের সমস্যায় আক্রান্ত হন। প্রায় ৪২ শতাংশ এশিয়ান পুরুষ এ রোগে আক্রান্ত। এদের অনেকেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বিব্রত বোধ করেন। ১৯৯৯ সালে প্রতি হাজারে ২২ জন আমেরিকান পুরুষ এ রোগ সংক্রান্ত পরামর্শের জন্য আসেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ৪০ থেকে ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত ৫০ শতাংশ জন পুরুষ ক্ষণস্থায়ী এবং আংশিক উত্থান জনিত সমস্যায় আক্রান্ত হয়। ডায়াবেটিস, কিডনি সমস্যা , মাদকাসক্তি, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তনালীর সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ৭০ শতাংশ এ রোগ ভুগে থাকেন। মানসিক অসুখের কারণে প্রায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ পুরুষ এ অসুখে ভোগেন। সকল ডায়াবেটিক রোগীই এ সমস্যায় ভুগে থাকেন। আবার হার্টের রোগীরাও কমবেশি আক্রান্ত।

পুরুষ অঙ্গের গঠন ও কর্ম পদ্ধতি (স্ট্রাকচার ও ফিজিওলজি)

পুরুষ জনন অঙ্গের অভ্যন্তরীণ গঠন বেশ জটিল । এতে দুটি নলাকার রক্ত ধারক কলা থাকে এবং এই নলাকার ধারকের মধ্যেই উত্তেজনার সময় রক্ত জমা হয়ে পুরুষাঙ্গ স্ফীত ও লম্বা হয়। উত্তেজনা প্রশমিত হলে আবার কলাগুলো সংকুচিত হয়ে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে। উত্তেজনা কমে গেলে রক্তাধারে জমাকৃত রক্ত আবার শরীরে ফিরে আসে। মূত্রনালী বেষ্টনাকারী রক্ত, দুটি প্রধান ধমনী, কয়েকটি শিরা যা পুরুষাঙ্গে রক্ত সরবরাহ করে ও স্নায়ুকলা যৌন উত্তেজনার সময় সংবেদনশীল হয়ে উঠে। এ রকম কয়েকটি অঙ্গের সমম্বয়েই পুরুষ জনন অঙ্গ তৈরি হয়।

উত্তেজনার উপযুক্ত কারণ ঘটলে মস্তিকে ও স্নায়ুতন্ত্রে উত্থানের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং রক্ত সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে তা জননতন্ত্রে নির্দেশনা পৌঁছায়। শারীরিক ও মানসিক উত্তেজনা স্নায়ুর মাধ্যমে রক্ত সংবহনতন্ত্রে বার্তা পাঠায় এবং জনন অঙ্গে রক্ত চলাচল বেড়ে যায়। ফলে এ অঙ্গটা স্ফীত ও শক্ত হয়ে ওঠে। উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে বীর্যপাত হয়ে গেলে পুরুষাঙ্গে রক্তের চাপ কমে যায়, এটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।

রোগ নির্ণয় :

ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ , যকৃতের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, মাদকাসক্তি, স্ত্রীর সাথে আন্তরিক সম্পর্কের অভাবেও এ সমস্যাটা হতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, প্রায় সব ডায়াবেটিক রোগী, হার্টের রোগী, কিডনি রোগী পুরুষাঙ্গের উত্থান জনিত সমস্যায় ভুগে থাকেন। উচ্চ রক্তচাপ কমানোর জন্য যারা বিভিন্ন ওষুধ খান তাদেরও এই সমস্যা হয়ে থাকে। শুধু তাই নয় বিভিন্ন মানসিক চাপ কমানোর ওষুধ, এলার্জির ওষুধ ও এসিড কমানোর ওষুধও এই সমস্যার সৃষ্টি করে। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা যৌন কর্মে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

শারীরিক পরীক্ষা :

সাধারণ শারীরিক পরীক্ষা ও জননতন্ত্রের বিস্তারিত পরীক্ষা , স্নায়ুতন্ত্রের রোগ, রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগ জন্মগত কোনো ত্রুটি যেমন হাইপোস্পেডিয়াস, পেইরোনিকস ডিজিজ ইত্যাদি বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করতে হবে। পুরুষের স্তন এবং চুলের অবস্থা পযর্বেক্ষণ করা প্রয়োজন। পুরুষের স্তন যদি বৃদ্ধি পায় এবং ঘন চুলের অধিকারী হন তবে তার ক্রোমোজম ও বিভিন্ন হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করাও জরুরি।

ল্যাবরেটরি পরীক্ষা :

হিমোগ্লোবিন, রক্ত শূন্যতা, হরমোন টেস্টোস্টেরন প্রল্যাকটিন, রক্তে চর্বির মাত্রা, আর্টেরিসসক্লেরোসিস, কম রক্ত সরবরাহ, সুগার, যকৃতের কার্যকারিতা, কিডনির কার্যকারিতা, থাইরয়েড কার্যকারিতা দেখা প্রয়োজন। কোনো কোনো সময় ক্রোমোজম পরীক্ষা এবং বিভিন্ন হরমোনের মাত্রা নিরুপণ করা প্রয়োজন হয়। প্রস্রাবে অতিমাত্রায় প্রোটিন ও সুগার আছে কিনা জানা প্রয়োজন ।

কার্যকর উত্থান পরীক্ষা (ডুপ্লেক্স আল্ট্রাসাউন্ড)

ডুপ্লেক্স আল্ট্রাসাউন্ডের সাহায্যে রক্ত সরবরাহ ও শিরার ছিদ্র নির্ণয় করা সম্ভব। আর্থেরোস্কে¬রোসিস, স্কারিং, ক্যালসিফেকেশনও আল্ট্রাসাউন্ডের মাধ্যমে নির্ণয় করা সম্ভব। পুরুষাঙ্গে বিশেষ ইনজেকশানের মাধ্যমে অথবা সিলডেনাফিল জাতীয় ট্যাবলেট খাওয়ানোর পর কালার ডপলার এবং ড্রপ্লেক্স আল্ট্রাসাউন্ড করলে পুরুষ জনন অঙ্গের ভেতরের অস্বাভাবিকতাগুলো বিশদভাবে ধরে পড়ে। এটা মনে রাখা দরকার যে এই ইনজেকশনের প্রভাবে পুরুষ জনন অঙ্গ চার ঘন্টার বেশি উত্থিত থাকলে এবং যদি ব্যথা হয় (প্রিয়াপজম) তবে দ্রুত তাকে কোনো ইউরোলজি সেন্টারে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন। চিকিৎসায় দেরি বা অবহেলা হলে পুরুষ জনন অঙ্গ পরে অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।

নিদ্রাকালীন পুরুষ জনন অঙ্গ উত্থান :

একজন স্বাভাবিক পুরুষের ঘুমের মধ্যে তার পুরুষ জনন অঙ্গটি ৫ থেকে ৬ বার পুরুষ জনন অঙ্গ উত্থিত হয়ে থাকে। এটা প্রতি ৯০ মিনিট পর পর কয়েক মিনিটের জন্য ঘটে থাকে। এর অনুপস্থিতি পুরুষ জনন অঙ্গের স্নায়ুর অসামঞ্জস্যতা বা রক্ত সরবরাহের অসুবিধা নির্দেশ করে। বিশেষ পরীক্ষা যেমন কাভারসনোগ্রাম বা কাভারসনোমেট্রি করে পরুষ অঙ্গের রক্তনালীর অবস্থা দেখা যেতে পারে। কৃত্রিমভাবে পুরুষা জনন অঙ্গের উত্থান ঘটিয়ে তার চাপের পরিমাপ নির্ণয় করা হয়। বিশেষ ওষুধ কনট্রাস্ট ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে এক্সরে করা হয় । এ পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক পুরুষ জনন অঙ্গের গঠন ও কর্ম পদ্ধতিতে কোনো ক্রটি আছে কিনা তা বুঝতে পারেন। তবে এ পরীক্ষাটি অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ বিধায় কদাচিৎ এটি করা হয়। কালার ডপলার এবং ড্রপ্লেক্স আল্ট্রাসাউন্ডের কারণে এই পরীক্ষাটি এখন আর জনপ্রিয় নয়।

চিকিৎসা :

যৌনশিক্ষা : এ পদ্ধতিতে মানসিক রোগজনিত উত্থান সমস্যার চিকিৎসা করা হয়। আমাদের দেশে যৌন শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় নবীন বয়সে রোগীর সামান্য যৌন সমস্যাকেই বিশাল সমস্যা বলে মনে করে প্রায়ই অপচিকিৎসার শিকার হয়ে মানসিক, শারীরিক এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। সাধারণ যৌনশিক্ষা যুব সম্প্রদায়কে এই বিপদ হতে রক্ষা করতে পারে। মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যক্রমে এ বিষয়ে একটি অধ্যায় যোগ করা যেতে পারে।

পিডিই৫ এনজাইম ইনহিবিটার

উত্থানের ক্ষেত্রে কার্যকর পিডিই৫ ইনহিবিটার (নিলডেনিফিল সাইট্রেট, টাডানাফিল এবং ভারডেনাফিল) ওষুধগুলোর ব্যবহার এ সমস্যার প্রাথমিক ওষুধ হিসেবে আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত এবং প্রায় ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত ফলপ্রসূ। সিলডানাফিল মিলনের ঘন্টা খানেক আগে খাবার পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। এর কার্যকারিতা প্রায় ২/৩ ঘন্টা স্থায়ী হয় খালি পেটে ওষুধটি সেবন করলে তার কার্যকারিতা বেশি হয়। টাডানাফিল ২০ এমজি প্রায় ৩৬ ঘন্টা কার্যক্ষম। এ কারণে ওষুধটি যে কোনো সময় খাওয়া যেতে পারে। এ দুটি ওষুধের কার্যকারিতা চমৎকার। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে এটা সবচেয়ে জনপ্রিয়। যাদের যকৃত ও কিডনি সংক্রান্ত অসুখ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এর মাত্রা কম রাখতে হবে।

পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া

মাথা ব্যথা, মুখমন্ডল ভার হয়ে আসা নাক বন্ধ হওয়া ইত্যাদি কোনো কোনো সময় অনুভূত হয়। তবে এর সমস্ত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সাময়িক সময়ের জন্য। ওষুধের কার্যকারিতা শেষ হলেই এর সমস্যাগুলো এমনিতেই চলে যায়।

পেনাইল ইমপ্লান্টস :

সর্বক্ষেত্রে পুরুষ জনন অঙ্গ উত্থানজনিত সমস্যা পূর্ব উল্লেখিত চিকিৎসা দিয়ে চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। যখন কোনো চিকিৎসাই ফলপ্রসূ হয় না তখন পেনাইল প্রস্থেসিসের প্রয়োজন হয়। সাধারণত দুই ধরণের পেনাইল প্রস্থেসিস চিকিৎসার জন্য পাওয়া যায়।

(১) সেমি রিজিড পেনাইল প্রস্থেসিস যা অত্যন্ত উন্নতমানের মেডিক্যাল গ্রেডের সিলিকন দ্বারা প্রস্তুতি। এটি দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা এবং দামও তুলনামুলকভাবে কম। সেমি রিজিড পেনাইল প্রস্থেসিস স্থাপন করাও তুলনামুলকভাবে সহজ। বাংলাদেশেও পদ্ধতিটি সহজলভ্য এবং মাত্র ৪০-পাঁচ লাখ ৬০ হাজার টাকার মধ্যে এই প্রস্থেসিস প্রতিস্থাপন সম্ভব।

(২) ইনফ্লেটেবল পেনাইল প্রস্থেসিস অপেক্ষাকৃত বেশি জটিল এবং হাইড্রোলিক পাম্প-সংবলিত একটি অত্যন্ত আধুনিক প্রতিস্থাপনীয় প্রস্থেসিস। এতে দুটি সিলিকন নল একটি ছোট ভাল্ব ও হাইড্রোলিক পাম্প থাকে। এ প্রযুক্তির সুবিধা হলো যখন এবং যতক্ষণ পুরুষ অঙ্গটি উত্থিত অবস্থায় রোগী বা তার সঙ্গীনি রাখতে চান ততক্ষণই সর্ম্পূণ কার্যক্ষম অবস্থায় রাখতে পারবেন। ইনফ্লেটেবল পেনাইল প্রস্থেসিসের অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এর প্রতিস্থাপন পদ্ধতি একটু জটিল ও কোনো কোনো সময় এতে যান্ত্রিক ত্রুটিও পরিলক্ষিত হয়। তবে দীর্ঘ স্থায়িত্বের কথা বিবেচনা করে এ পদ্ধতিটি অনন্য। বাংলাদেশী মুদ্রায় আনুমানিক চার লাখ টাকার মতো খরচ হতে পারে।

পুরুষের যৌন সমস্যা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। আমাদের দেশে এসব বিষয়ের অপচিকিৎসার এমনই বিস্তৃতি লাভ করেছে যে তা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক চিকিৎসায় পুরুষদের সকল যৌন সমস্যার সমাধান করা যায়। মেডিকেল চিকিৎসার সাথে সাথে সার্জিক্যাল চিকিৎসাও অত্যান্ত ফলপ্রসূভাবে সর্ম্পণ করা হচ্ছে। মেডিকেল বিশ্ব বিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের, এন্ড্রোলজি এন্ড ফিমেল ইউরোলজি ইফনিট প্রতি রবি ও মঙ্গলবার বর্হিবিভাগে চিকিৎসা সেবাসহ আন্তবিভাগে সর্বপ্রকার যৌন সমস্যার রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে যৌন রোগ বা সমস্যার বিষয়ে ইউরোলজি ও এন্ড্রোলজি চিকিৎসকরাই যে সঠিক সেবা দিতে পারে। সে ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। আশার কথা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পযর্ন্ত ইউরোলজি সার্ভিস চালু হয়েছে। সাধারণ মানুষ সঠিক চিকিৎসা পাবেন এখান থেকে।

আরএম-১০/২৫/০২ (স্বাস্থ্য ডেস্ক)