প্রধানমন্ত্রী দৌঁড়ে মায়াবতী, মমতা

ভারতে সাত পর্বের লোকসভা নির্বাচনের ষষ্ট পর্বের ভোটগ্রহণ শেষ। বাকী রয়েছে একটি মাত্র পর্ব। শেষ পর্বে আগামী ১৯ মে আট রাজ্যের ৫৯ টি আসনে ভোট। ফল আগামী ২৩ মে। কিন্তু তার আগেই চিড় ধরেছে বিজেপি বিরোধী শিবিরে। ফাটলের কারণ একটাই-প্রধানমন্ত্রীর পদের অন্যতম দাবিদার-তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি ও বহুজন সমাজ পার্টি (বসপা) নেত্রী মায়াবতীর মধ্যে রাজনৈতিক লড়াই।

আগামী ২১ মে দিল্লিতে বিরোধী শিবিরের সব নেতা-নেত্রীদেরকে নিয়ে বৈঠক ডেকেছে কংগ্রেস। কিন্তু সেই বৈঠকে যাওয়ার অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন মমতা, মায়াবতী। বৈঠকে গড় হাজির থাকতে পারেন সপা নেতা অখিলেশ যাদবও। সেই সাথে বৈঠক শেষে রাষ্ট্রপতির কাছেও যাওয়ার কথা ছিল তাদের। রাষ্ট্রপতিকে জানানোর কথা ছিল সরকার গঠনের আগে তিনি যেন বিরোধীদের সাথে কথা বলেন।

সবমিলিয়ে একটা বিষয় পরিস্কার যে, মুখে মোদিকে দিল্লি থেকে হঠানোর কথা বললেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরোধীদের মধ্যে ঐক্যের অভাব স্পষ্ট।

গত সপ্তাহেই চন্দ্রবাবু নাইডু পশ্চিমবঙ্গ সফরে এসে তৃণমূল কংগ্রেস প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেসময়ই নাইডু যখন ২১ তারিখের প্রস্তাবিত বৈঠক নিয়ে আলোচনা করেন তখনই মমতা জানিয়ে দেন ২৩ তারিখ ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগে এই ধরনের বৈঠকের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। একই অভিমত প্রকাশ করেছেন মায়াবতীও।

আসলে ভোটের ফলেই নিজেদের ওজন বুঝে নিতে চাইছেন মমতা-মায়াবতী-অখিলেশরা। বিরোধী দল একত্রে কত আসন পেতে পেতে তাও মাথায় রাখতে হচ্ছে-যাতে দর কষাকষিতে সুবিধা হয়।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট যদি কেন্দ্রে ফের ক্ষমতায় আসতে না পারে সেক্ষেত্রে বিরোধী শিবিরের তরফে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসাবে কার নাম তুলে ধরা হবে, তা নিয়ে এখনও সন্দেহ আছে। এই পদে মমতা ও মায়াবতী-উভয়েই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আবার প্রধানমন্ত্রীর পদে দৌড়ে রয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীও এবং অনেক বিরোধী নেতারাই প্রধানমন্ত্রী পদে রাহুলকেই সমর্থন করেছেন। যদিও নিজেদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে কেউই আগ বাড়িয়ে নিজের নামটি সামনে আনতে চাইছেন না। যদিও ডিএমকে সহ কয়েকটি দল ইতিমধ্যেই পিএম পদে রাহুলের নাম প্রস্তাব করেছে।

কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল তৃণমূল ও বসপা-দুই দলই তাদের নিজেদের রাজ্যে কংগ্রেসের সাথে কোন জোটে যায় নি। এমনকি জাতীয় রাজনীতিতে একে অপরের সঙ্গী হলেও রাজ্যে দূরত্ব বজায় রেখেছে। এটা ঠিক যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কংগ্রেসের সাথে কোন সম্পর্ক নেই মমতার। কিন্তু ভোট গণনার পর নরেন্দ্র মোদিকে পিএম পদ থেকে সরাতে প্রয়োজনে কংগ্রেসকে সমর্থন করলেও করতে পারেন যদিও সেই সম্ভাবনা অনেক কম। কারণ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মতো এবারও মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস যদি সর্বোচ্চ আসনে জয় পায় তবে প্রধানমন্ত্রী পদে তিনি নিজেই তার নামটা ভাসিয়ে দিতে পারেন।

কংগ্রেস থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন বসপা নেত্রী মায়াবতীও। এখনও পর্যন্ত কংগ্রেসের সাথে কোন আপোষে যেতে রাজি নন বহেনজি।

সাম্প্রতিক কালে কয়েকটি অনুষ্ঠান থেকে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের কংগ্রেস সরকারকে প্রবল তোপ দাগেন মায়াবতী চলতি লোকসভা নির্বাচনেই উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের সাথে আসন সমঝোতা করেনি বসপা নেত্রী। রাজনৈতিক সমীকরণই আভাষ দিচ্ছে যে মায়াবতী কোনমতেই প্রধানমন্ত্রী পদে কংগ্রেসকে সমর্থন করবেন না। বরং এনডিএ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে এবং উত্তরপ্রদেশে বসপা-সপা জোট বেশি আসন পেলে-মায়াবতী নিজেই প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য তার নাম সামনে আনতে পারেন। এই জল্পনা ছড়িয়েছে তার একটি মন্তব্যকে ঘিরে। সপ্তাহ খানেক আগেই উত্তরপ্রদেশে আম্বেদনগর থেকে তিনি

ঘোষণা দেন ‘সবকিছু ঠিকঠাক চলছে লোকসভা আসনে তিনি লড়াই করতে পারেন।’ যদিও মমতা এখনও পর্যন্ত নিজের মুখে এরকম কোন ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন নি ঠিকই, তবে দলের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সব গুণই আছে তাদের নেত্রীর মধ্যে।

তবে মায়াবতী না চাইলেও ভারতের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী মায়াবতীর প্রশংসা করতে দেখা গিয়েছিল। দিল্লি থেকে মোদিকে উৎখাত করতে প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর পদে মায়াবতীকে সমর্থন দিতে পারেন তিনি।

সাক্ষাৎকারে রাহুলকে বলতে শোনা যায় ‘আমি মায়াবতীকে সম্মান করি, ভালবাসি। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক লড়াই আছে এবং আমরা কংগ্রেসের আদর্শ রক্ষার লড়াই করি। কিন্তু দেশের প্রতি মায়াবতীর অবদানকে আমি প্রশংসা করি।’ কিন্তু মমতা সম্পর্কে এরকম কোন মন্তব্য করতে শোনা যায় নি রাহুলের মুখে। বরং মমতা ও রাহুলের মধ্যে বাগযুদ্ধ চলছেই। রাজ্যে নির্বাচনী জনসভায় এসে মমতার সরকারকে নিশানা করতে ছাড়েন নি রাহুল। তার অভিযোগ ছিল মমতার শাসনকালে রাজ্যের কোন উন্নয়নই হয়নি। রাহুলের এই অভিযোগের পর তাকে ‘বাচ্চা’ ছেলে কটাক্ষ করেছিলেন মমতা।

এখন প্রশ্ন হল লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর মমতা-মায়াবতীর ভূমিকা কি হবে? এনডিএ যদি সরকার গঠনের প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়-সেক্ষেত্রে মমতা ও মায়াবতী উভয়েই প্রধানমন্ত্রীর পদে অন্যতম দাবিদার হবেন। আর তাই যদি হয় তবে মায়াবতীর দিকেই

পাল্লা ভারী। কারণ মমতাকে সমর্থন করতে নারাজ বাম দলগুলিও। মোদিকে সরাতে কেন্দ্রে যে কোন বিকল্প জোটকে সমর্থন দিতে রাজি হলেও তৃণমূল কংগ্রেস সেই জোটের শরিক হলে তাতে সমর্থন দিতে আপত্তি সিপিআইএম-এর।

দলের পলিটব্যুরোর এক সদস্য জানান ‘এরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে আমাদের অবস্থান কি হবে তা এখনও পরিস্কার নয়। তৃণমূলকে সমর্থন করার অর্থই হল বাংলায় আমাদের আত্মহত্যা করা। কিন্তু কেন্দ্র থেকে বিজেপিকে হটানোটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’

সিপিআইএম’এর সর্বভারতীয় সভাপতি সীতারাম ইয়েচুরি জানান ‘কেন্দ্রে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠনের ক্ষেত্রে তার দল সবসময়ই বাইরে থেকে সমর্থন করেছে-সেটা ১৯৯৬ সালে এইচ.ডি.দেবগৌড়ার সরকার হোক বা ২০০৪ সালের পর সরকার গঠনের ক্ষেত্রে হোক।’

আর সবকিছু দেখে চুপ করে বসে নেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও। বিরোধীদের জোটকে ‘মহাঘোঁট’ বলে কটাক্ষ করেছেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী জনসভায় উপস্থিত হয়েই তিনি জানান ‘কেউ কেউ ৪০ টা, ২৫টা, ২০টা আসনে লড়াই করেই প্রধানমন্ত্রী পদের দাবি জানাচ্ছে। সবাই পায়ে নূপুর বেঁধে নেমে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে।’

এসএইচ-২৪/১৪/১৯ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)